বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ এমন এমন ক্ষতের বোঝা বইছেন, যেগুলো বছরের পর বছর কেটে গেলেও পুরোপুরি সারে না। ডায়াবেটিস, রক্তসঞ্চালনের দুর্বলতা বা দীর্ঘক্ষণ চাপ পড়ার মতো কারণেই সাধারণত এ ধরনের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি হয়। এধরনের ক্ষতগুলো শুধু যন্ত্রণাদায়কই নয়, সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়ায় এবং জীবনমানকেও মারাত্মকভাবে নষ্ট করে। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যর্থ হয়ে এমন ক্ষত থেকে অঙ্গচ্ছেদের মতো কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে হয়।
সমস্যা হল— এতদিন পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞান মূলত ক্ষতের লক্ষণ সামলাতেই ব্যস্ত ছিল; সমস্যার গভীরে থাকা জটিল বৈজ্ঞানিক কারণটিই রয়ে গিয়েছিল আড়ালে। ফলে রোগীদের বারবার ড্রেসিং পরিবর্তন, অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার অবিরাম চক্রে পড়তে হয়।
সেই আড়াল সরিয়ে নতুন এক দৃষ্টিকোণ হাজির করেছেন গবেষকেরা। তাঁদের সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে, এমন ক্ষত সারাতে ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো ত্বকের একটি পরিচিত জিন—MC1R। সাধারণত লাল চুল ও অত্যন্ত ফর্সা ত্বকের পেছনে কার্যকর এই জিন যে ক্ষত সারানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক প্রক্রিয়াও নিয়ন্ত্রণ করে, তা এতদিন স্পষ্ট ছিল না।
গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতগুলিতে MC1R-এর স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত হয়। ত্বকের ইমিউন কোষ থেকে শুরু করে কেরাটিনোসাইট, ফাইব্রোব্লাস্ট এবং রক্তনালীর আবরণী কোষ—প্রায় সব স্তরেই থাকে এই জিনের প্রভাব। ফলে ক্ষত সারানোর প্রতিটি ধাপেই MC1R একটি সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে। স্বাভাবিক ক্ষতে শরীর প্রদাহ তৈরি করে জীবাণু ও ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু পরিষ্কার করে, তারপর সেই প্রদাহ ধীরে ধীরে কমিয়ে দেয়—সেখান থেকেই শুরু হয় মেরামতের কারুকার্য। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতে দেখা যায়, এই প্রদাহ বন্ধ করার সুইচটা আর কাজ করে না।
গবেষণায় দেখা গেছে, তিন ধরনের স্থায়ী প্রকৃতির ক্ষত যেমন- ডায়াবেটিক ফুট আলসার, ভেনাস লেগ আলসার ও প্রেশার আলসারে—MC1R ও তার সঙ্গী অণু POMC দুটোই ভারসাম্যহীন অবস্থায় থাকে।
বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয় যখন গবেষকেরা এমন ইঁদুরের উপর পরীক্ষা চালান, যাদের MC1R জিন কার্যকর নয়। এসব ইঁদুরে ক্ষত ধীরে সারে এবং মানুষের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতের মতো অতিরিক্ত প্রদাহ, ইমিউন কোষ জমাট বাঁধা ও “নিউট্রোফিল এক্সট্রাসেলুলার ট্র্যাপস” দেখা যায়— যা দীর্ঘদিন থাকলে ক্ষত সারানো আরও বাধাপ্রাপ্ত হয়।
সবচেয়ে উৎসাহজনক ফল পাওয়া গেছে একটি নতুন ইঁদুর-মডেলে, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে প্রদাহে আটকে থাকা ক্ষতের মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। সেখানে MC1R সক্রিয় করতে সক্ষম একটি ত্বকের ওষুধ প্রয়োগ করলে ক্ষত দ্রুত শুকিয়ে আসে, রক্তনালীর বৃদ্ধি বাড়ে, প্রদাহ কমে এবং ত্বকের বাইরের স্তর পুনর্গঠিত হতে থাকে। এমনকি সুস্থ ইঁদুরের ছোট ক্ষতেও এই ওষুধ রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে তুলেছে এবং দাগ কমিয়েছে।
গবেষণার সারকথাটি হল —MC1R আমাদের ত্বকের মেরামত-ব্যবস্থার এক কেন্দ্রীয় উপাদান। এটি কাজ না-করলে ক্ষত প্রদাহের জালে আটকে যায়; আর সক্রিয় হলে সেই স্থবিরতা ভেঙে শরীর আবার স্বাভাবিকভাবে সুস্থ হতে পারে। ভবিষ্যতে এ আবিষ্কারের ভিত্তিতে মলম বা জেলের মতো সহজলভ্য চিকিৎসা তৈরি হলে লাখো মানুষের জন্য দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত আর জীবনব্যাপী অভিশাপ হয়ে থাকবে না—বরং মানুষ নিজেই বাড়িতে ব্যবহার করতে পারবে। দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতের চিকিৎসার নতুন দিগন্তের হদিশ দিল এই ‘লাল চুলের জিন’।
সূত্র : Red Hair Gene Could Explain Why Some Wounds Never Heal by Jenna Cash, The Conversation, 29th November,2025.
