উল্টো ছাপা মানচিত্র ও ভূগোল 

উল্টো ছাপা মানচিত্র ও ভূগোল 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫

সম্প্রতি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নতুন গবেষণায় দেখা গেছে ৫০০ বছর আগে ১৫২৫ সালে প্রকাশিত প্রথম মানচিত্র-সমৃদ্ধ বাইবেলটি শুধু ধর্মীয় বইয়ের ইতিহাসেই নয়, আধুনিক বিশ্বরাজনীতির ধারণাতেও গভীর ছাপ রেখে গেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি—এই বাইবেলের পবিত্রভূমির মানচিত্রটি ভুলভাবে ছাপা হয়েছিল। ভূমধ্যসাগরকে ভুলবশত পূর্ব দিকে রেখে পুরো মানচিত্রটাই উল্টোমুখে মুদ্রিত হয়। তবুও এটিকেই বলা হচ্ছে প্রকাশনার ইতিহাসে একসঙ্গে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এবং সবচেয়ে বড় সাফল্য।

গবেষক অধ্যাপক নাথান ম্যাকডোনাল্ড জানিয়েছেন, মানচিত্রটি জুরিখের ছাপাখানায় তৈরি হয়েছিল এবং কারিগররা পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় ভূগোল সম্পর্কে এতটাই কম জানতেন যে কোনো ভুলই তাদের চোখে পড়েনি। কিন্তু এই ভুল মানচিত্রই বাইবেলকে নতুন রূপ দিল। রেনেসাঁস–শিল্পের নান্দনিকতা, সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক চিত্র এবং আধুনিক সীমান্তের ধারণাকে একত্রে নিয়ে এলো। আজকের দিনে প্রায় সব বাইবেলের শেষ পৃষ্ঠায় আমরা যে মানচিত্র দেখি, তার উৎস এই সংস্করণই।

ক্রিস্টোফার ফ্রশাউয়ার প্রকাশিত ১৫২৫ সালের এই পুরাতন নিয়মের মাত্র কয়েকটি কপি পৃথিবীর বিভিন্ন গ্রন্থাগারে টিকে আছে। কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের রেন লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত কপিটিতে লুকাস ক্রানাখ দ্য এল্ডারের আঁকা মানচিত্র দেখা

যায়। ইসরায়েলের বারো গোত্রের ভূখণ্ড, মরুভূমির যাত্রাপথ, নাসরত থেকে জেরিকো পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাস্থল—সবই চিত্রিত।

মধ্যযুগে আঁকা মানচিত্রগুলি ছিল মূলত প্রতীকী —আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার ও পবিত্র বর্ণনাকে দৃশ্যমান করার উপায়। কিন্তু লুকাস ক্রানাখ দ্য এল্ডারের আঁকা এই নতুন মানচিত্রে ইসরায়েলের বারো গোত্রের সীমানা, মরুভূমির পথ, প্রধান প্রধান বাইবেলীয় স্থান—সবকিছু এত সুচারুভাবে দেখানো হয়েছিল যে পাঠকেরা প্রথমবারের মতো পবিত্র গ্রন্থপাঠকে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করতে পারলেন।

এই বাইবেল–মানচিত্রের পর থেকে ইউরোপে রাজনৈতিক মানচিত্রে সীমারেখার ধারণা বদলে গেল। ক্রমান্বয়ে গোত্রভিত্তিক এই বিভাজন আধুনিক রাষ্ট্রসীমার ধারণাকে উৎসাহিত করল।

ম্যাকডোনাল্ড বলেন, বাইবেল কখনো আধুনিক সীমান্তের মতো রাজনৈতিক রেখা আঁকার কথা বলেনি। কিন্তু ১৫ থেকে ১৭ শতকের নতুন রাষ্ট্রচিন্তার সঙ্গে বাইবেলের মানচিত্রগুলি মিশে এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলল

যা আজো টিকে আছে। অনেকের কাছে তাই রাষ্ট্রসীমা যেন ‘ঈশ্বরনির্দিষ্ট’ সত্য। ফলে, বাইবেলের ভূগোল, যা মূলত আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক বর্ণনার অংশ ছিল, তাকে পরবর্তীকালে পড়তে শুরু করা হলো আধুনিক ভূ-রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে। ম্যাকডোনাল্ড সতর্ক করে বলেন, এই সরলীকরণ ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ প্রাচীন পাঠ আধুনিক সীমান্তনীতির মতো ধারণা নিয়ে লেখা হয়নি।

আজও বহু মানুষ রাষ্ট্রসীমা ও জাতির ধারণাকে ‘বাইবেলসমর্থিত সত্য’ হিসেবে দেখেন, যা ম্যাকডোনাল্ডের মতে বিপজ্জনক ভুল ব্যাখ্যার পথ খুলে দেয়। এমনকি আধুনিক প্রচারমাধ্যমেও সীমান্তরক্ষার কাজকে ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে তুলে ধরা হয়।

তাই গবেষকদের আহ্বান—মানচিত্র, ইতিহাস ও ধর্মীয় গ্রন্থের সম্পর্ককে আরও সতর্ক দৃষ্টিতে দেখা জরুরি। কারণ, পাঁচ শতাব্দী আগের একটি উল্টোমুখী মানচিত্র এখনও আমাদের রাজনৈতিক কল্পনাকে নীরবে প্রভাবিত করে চলেছে। আধুনিক রাষ্ট্রনীতির দাবি যখন পবিত্র গ্রন্থের নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন ইতিহাস ও রাজনীতির প্রকৃত প্রেক্ষাপট বিকৃত হতে পারে।

 

সূত্র: “Ancient Israel and the Modern Bounded State” by Nathan MacDonald, 29 November 2025, The Journal of Theological Studies.

DOI: 10.1093/jts/flaf090

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × four =