ক্ষতচিহ্ন বিহীন মহাজাগতিক বিস্ফোরণ

ক্ষতচিহ্ন বিহীন মহাজাগতিক বিস্ফোরণ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫

বিজ্ঞানীরা ক্রমশ স্পষ্ট প্রমাণ পাচ্ছেন, পৃথিবী অতীতে বহুবার এমন শক্তিশালী মহাজাগতিক বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেগুলো ভূ-পৃষ্ঠে কোনো দৃশ্যমান ক্ষতচিহ্ন রাখেনি। এই রহস্যময় ঘটনাগুলোকে বলা হয় টাচডাউন এয়ারবার্স্ট। ধূমকেতু বা গ্রহাণু ভূমিতে না পড়ে আকাশেই বিস্ফোরিত হয়, এবং আগ্নেয় তাপ ও প্রবল চাপের ঢেউ মুহূর্তে নীচের ভূভাগকে বিধ্বস্ত করে ফেলে।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সান্তা বারবারার ভূবিজ্ঞানী জেমস কেনেটের নেতৃত্বে চারটি নতুন গবেষণা এই ধারণাকে আরও দৃঢ়ভাবে উত্থাপন করেছে। তাঁদের মতে, টাচডাউন এয়ারবার্স্ট মানবসভ্যতা, জলবায়ু ও প্রাণীকূলের ইতিহাসে বড় ভূমিকা রেখেছে, কিন্তু পৃষ্ঠে দৃশ্যমান স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন না থাকায় সেগুলো দীর্ঘদিন নজরের বাইরে ছিল।

প্লস ওয়ান–এ প্রকাশিত এক গবেষণায় এই প্রথম পৃথিবীর শেষ বরফযুগের শেষে ঘটে যাওয়া এক আকস্মিক, স্বল্পস্থায়ী তীব্র শীতল জলবায়ু পর্ব সংক্রান্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে গ্রিনল্যান্ডের পশ্চিমে ব্যাফিন উপসাগরের গভীর পলল স্তরে। প্রায় ১২,৮০০ বছর আগে ঘটেছিল এই ধূমকেতু-বিস্ফোরণ, যা হঠাৎ বৈশ্বিক শীতলতা, বহু বৃহদাকারের প্রাণীর বিলুপ্তি এবং মানব সংস্কৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত বলে অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন।

ব্যাফিন উপসাগরের তলদেশের ২,০০০ মিটার গভীরে পাওয়া প্লাটিনাম-ইরিডিয়ামের উচ্চমাত্রা, ধাতব স্ফেরুল (ক্ষুদ্র আগ্নেয় অনুবলয়), গলিত কাচ এবং প্রচন্ড বিস্ফোরণের চাপে বিকৃত কোয়ার্টজ—সবই ইঙ্গিত দিচ্ছে এক ভয়ংকর বিস্ফোরণের দিকে। এর ধ্বংসাবশেষ বায়ুমণ্ডল পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে একটি কার্বনসমৃদ্ধ “ব্ল্যাক ম্যাট”/ গাঢ় কালো রঙের জৈব সমৃদ্ধ স্তর তৈরি করেছিল।

লুইজিয়ানার পারকিন্স এলাকার একটি ঋতুভিত্তিক অগভীর হ্রদকে গবেষকেরা সম্ভাব্য আকস্মিক হিম যুগের প্রথম গর্ত / খাদ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। হ্রদের চারপাশে ১ মিটার উঁচু প্রান্ত এবং সেখানকার পলল স্তরে পাওয়া গলিত কাচ, স্ফেরুল ও বিকৃত কোয়ার্টজের সঙ্গে এয়ারবার্স্ট থেকে উৎপন্ন প্রভাবের মিল আছে। তবে গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা নিশ্চিত করতে আরও বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

১৯০৮ সালের সাইবেরিয়ার তুঙ্গুস্কা বিস্ফোরণ মানব ইতিহাসের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীর নথিভুক্ত এয়ারবার্স্ট। গাছের সারি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল, আকাশে দেখা গিয়েছিল জ্বলন্ত অগ্নিগোলক । নতুন গবেষণায় সেখানে এই প্রথম বিকৃত কোয়ার্টজ, গলিত ধাতু ও কার্বন, এবং উচ্চতাপে তৈরি ক্ষুদ্র ধাতব আণবিক বলয় শনাক্ত হয়েছে।

অনুরূপ ধ্বংসের চিহ্ন পাওয়া গেছে জর্ডান উপত্যকার প্রাচীন নগর টল এল-হাম্মামেও। সেখানে প্রায় ৩,৬০০ বছর আগে একটি শক্তিশালী এয়ারবার্স্ট পুরো শহরটিকে পুড়িয়ে ও ভেঙেচুরে দিয়েছিল বলে ধারণা।

সব মিলিয়ে গবেষকেরা সতর্ক করছেন, টাচডাউন এয়ারবার্স্ট যদিও ভূমিতে বড় গর্ত সৃষ্টি করে না, তা সত্ত্বেও এগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী ও বহুল-ঘটিত মহাজাগতিক বিস্ফোরণ। দৃশ্যমান খাদ বা গভীর গর্ত না থাকার কারণে এই ঘটনাগুলো নিয়ে গবেষণা দীর্ঘদিন উপেক্ষিত ছিল। এগুলো ব্যাপক ভূখণ্ড ধ্বংস করতে পারে এবং পৃথিবীর জলবায়ু ও সভ্যতার গতিপথ বদলে দিতে সক্ষম। তাই এমন ঘটনাগুলোকে আরও গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা করা জরুরি।

 

সূত্র: “A 12,800-year-old layer with cometary dust, microspherules, and platinum anomaly recorded in multiple cores from Baffin Bay” by Christopher R. Moore, Vladimir A. Tselmovich, et.al; 6 th August 2025, PLOS ONE.

DOI: 10.1371/journal.pone.0328347

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × one =