মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক সাধারণত ইতিবাচক ভাবেই উপস্থাপিত হয়, যেমন, সবুজ দেখলে চোখের আলাদাই আরাম লাগে, খোলা বাতাসে মন হালকা ফুরফুরে লাগে, পাখির ডাক মানসিক প্রশান্তি আনে। কিন্তু লুন্ড ইউনিভার্সিটির নতুন গবেষণা জানাচ্ছে এক ভিন্ন গল্প: এই পরিচিত দৃশ্যের সমান্তরালে দ্রুত বেড়ে চলেছে এক নতুন প্রবণতা। যার নাম ‘বায়োফোবিয়া’ বা প্রকৃতি ভীতি। প্রাণী, পাখি, এমনকি গাছ–গাছালির প্রতিও ভয়, অস্বস্তি বা ঘৃণার মতো নেতিবাচক অনুভূতি। এক সাম্প্রতিক বৃহৎ সমীক্ষা এই উদীয়মান সামাজিক–মানসিক সংকটকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ২০০টি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ একত্র করে বায়োফোবিয়ার জন্ম, প্রভাব এবং সম্ভাব্য সমাধানের উপর একটি সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ফলাফল বলছে—প্রকৃতিকে ভয় পাওয়ার পিছনে প্রধান চালিকা শক্তি দুটি : বাহ্যিক পরিবেশগত প্রভাব এবং মানুষের অভ্যন্তরীণ মানসিক বৈশিষ্ট্য।
প্রথমত, দ্রুত নগরায়ণের ফলে মানুষের দৈনন্দিন জীবন এখন ক্রমেই কংক্রিটের চার দেয়ালে আবদ্ধ। শিশুদের প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ কমে যাওয়ায় প্রকৃতি তাদের কাছে আর ব্যাপ্ত, নিরাপদ স্থান হিসাবে পরিচিত নয়—বরং অপরিচিত, অনিশ্চিত এবং কখনও-বা ভীতিকর। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে মিডিয়ার প্রভাব—ফিল্ম, সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকৃতিকে প্রায়ই বিপজ্জনক বা অস্বস্তিকর রূপে দেখানো হয়, যা ভয়ের বীজকে আরও গভীর করে।
দ্বিতীয়ত, ব্যক্তির মানসিক গঠন—যেমন উদ্বেগপ্রবণতা, স্বাস্থ্যগত দুর্বলতা বা পূর্বের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা প্রকৃতির প্রতি বিরূপতা বাড়াতে পারে। গবেষকরা বলছেন, প্রকৃতির সঙ্গে কম যোগাযোগ এই ভীতিকে আরও শক্তিশালী করে, ফলে মানুষ ধীরে ধীরে এমন এক নেতিবাচক ঘূর্ণিতে আটকে যায় যেখানে অজানা জিনিসের প্রতি ভয় বাড়তেই থাকে।
এই বায়োফোবিয়ার প্রভাব গভীর ও বহুমাত্রিক। এ ভীতি শুধু মানসিক অস্বস্তি সৃষ্টি করে না, এর প্রভাব পৌঁছে যায় স্বাস্থ্য থেকে পরিবেশ–নীতি পর্যন্ত। প্রকৃতির স্পর্শে যে মানসিক প্রশান্তি, স্ট্রেস কমানো, মনোযোগ বাড়ানোসহ নানা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত উপকারিতা আছে, সেগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। শুধু তাই নয়, পাশাপাশি, প্রকৃতিকে ‘ঝুঁকি’ হিসেবে দেখার প্রবণতা সংরক্ষণমুখী আচরণকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। নিরীহ বা উপকারী প্রাণীকেও ‘বিপজ্জনক’ ভাবা সংরক্ষণ প্রচেষ্টার সঙ্গে মৌলিক দ্বন্দ্ব তৈরি করে।
গবেষকদের মতে, এই প্রবণতা উল্টো দিকে ঘোরাতে হলে প্রয়োজন জীবনের শুরুতেই প্রকৃতির সান্নিধ্য বাড়ানো, শহরে সবুজ ও জীববৈচিত্র্যময় পরিবেশ তৈরি করা এবং প্রকৃতিকে ঘিরে ভুল ধারণা ভাঙার মতো সচেতনতা বৃদ্ধি। সহজ কথায় বলতে গেলে বায়োফোবিয়া শুধুমাত্র একটি মানসিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং সমাজ, পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ সংরক্ষণকে প্রভাবিতকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক বিষয়। প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন করাই আগামী দিনের বড় চ্যালেঞ্জ।
সূত্র : Growing Fear of Nature: Study Reveals Causes of Rising Biophobia
by Johan Kjellberg Jensen et al. Frontiers in Ecology and the Environment, 4th December,2025.
