বিশ্বজুড়ে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উৎপাদনের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো সাশ্রয়ী এবং দক্ষ হাইড্রোজেন উৎপাদন প্রযুক্তি তৈরি করা। এক্ষেত্রে নতুন আশার আলো দেখিয়েছেন শেনইয়াং অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি ও গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির গবেষকেরা। তাঁরা কাগজশিল্পে উৎপন্ন সস্তা বর্জ্য উপাদান লিগনিন ব্যবহার করে এক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অনুঘটক তৈরি করেছেন। এ অনুঘটক জলবিদ্যুৎভিত্তিক হাইড্রোজেন উৎপাদনের যা কঠিনতম ধাপ সেই অক্সিজেন ইভোলিউশন রিঅ্যাকশনকে (ও ই আর) উল্লেখযোগ্যভাবে আরও দ্রুত ও স্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
গবেষণাটি বায়োচার এক্স–এ প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা গেছে, নতুন অনুঘটকটি লিগনিন থেকে তৈরি কার্বন তন্তুতে নিকেল অক্সাইড (NiO) ও আয়রন অক্সাইড (Fe₃O₄) ন্যানোকণা খচিত উপাদান। মাত্র ২৫০ মিলিভোল্ট অতিরিক্ত বৈদ্যুতিক চাপে ১০ mA/cm² বৈদ্যুতিক ঘনত্বে কাজ করতে পারে এবং উচ্চ কারেন্টে টানা ৫০ ঘণ্টার বেশি স্থিতিশীল থাকে। শিল্পমানের ইলেক্ট্রোলাইজারে ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত এ এক গুরুত্বপূর্ণ সূচক।
এসব কর্মক্ষমতা সাধারণত ব্যয়বহুল প্লাটিনাম–গ্রুপ ধাতুর অনুঘটকে দেখা যায়। ফলে এই বায়োমাস-উৎপন্ন বিকল্পটি শিল্পের জন্য আরও সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব সমাধান হিসেবে উঠে আসতে পারে। লিগনিন পৃথিবীর অন্যতম প্রাচুর্যপূর্ণ প্রাকৃতিক পলিমার হলেও এর শিল্পোৎপাদিত বেশিরভাগ অংশই কম দক্ষতা পর্যায়ে জ্বালানি হিসেবে পুড়িয়ে ফেলা হয়। গবেষকেরা ইলেক্ট্রোস্পিনিং ও তাপপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই লিগনিনকে পরিবাহী ও শক্তিশালী কার্বন তন্তুতে রূপান্তর করেছেন। এসব তন্তু শুধু যে ধাতব ন্যানোকণার জন্য স্থিতিশীল অবলম্বন তাই নয়, উপরন্তু বিক্রিয়ার সময় দ্রুত ইলেকট্রন চলাচল নিশ্চিত করে। ফলে গঠিত হয় NiO/Fe₃O₄@LCFs—একটি নাইট্রোজেন–মিশেল দেওয়া কার্বন কাঠামো। এটি দ্রুত চার্জ পরিবহন, বড় সক্রিয় পৃষ্ঠ ও উচ্চ কাঠামোগত স্থায়িত্ব দেয়।
আণুবীক্ষণিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নিকেল ও আয়রন অক্সাইড ন্যানোকণাগুলো কার্বন তন্তুর ভেতরে সূক্ষ্ম ‘ন্যানোস্কেল হেটারোজাংশন’ তৈরি করে। দুটি ভিন্ন ধরনের অর্ধপরিবাহী পদার্থের মধ্যে তৈরি হওয়া সংযোগস্থলের এই বিশেষ সংযোগই ও ই আর–এর গতি বাড়িয়ে দেয়। কারণ এটি প্রতিক্রিয়ার মধ্যবর্তী অণুগুলোকে ঠিক মতো আবদ্ধ ও বিচ্ছিন্ন হতে সাহায্য করে। পাশাপাশি কার্বন নেটওয়ার্ক ন্যানোকণার জমাট বেঁধে যাওয়াকে প্রতিরোধ করে – যা প্রচলিত ধাতব অনুঘটকগুলির এক সাধারণ দুর্বলতা।
ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল পরীক্ষায় দেখা গেছে, দ্বি-ধাতু এই উপাদানটি এক-ধাতু অনুঘটকের তুলনায় অনেকটা কার্যকর। এর প্রতিক্রিয়ার গতি-ঢাল মাত্র ১৩৮ mV/dec, যা দ্রুত বিক্রিয়াগতির নির্দেশক। রমন বর্ণালীবীক্ষণ ও ডেনসিটি ফাংশনাল থিওরি/ ইলেকট্রন ঘনত্বভিত্তিক গণনা তত্ত্বের হিসেবও নিশ্চিত করেছে যে প্রকৌশলকৃত স্পর্শ-তলই (ইন্টারফেস) এর উচ্চ কার্যকারিতার মূল উৎস।
গবেষকেরা মনে করছেন, বিশ্বব্যাপী বিপুল পরিমাণে উৎপন্ন লিগনিনের সহজলভ্যতা এই প্রযুক্তিকে শিল্পায়নের পথে এগিয়ে নেবে। পুনর্নবীকরণযোগ্য উদ্ভিদ-বর্জ্য থেকে তৈরি অনুঘটক কার্বন কাঠামোর সঙ্গে সস্তা ধাতব অক্সাইডের সমন্বয় ভবিষ্যতের সবুজ হাইড্রোজেন উৎপাদনকে আরও টেকসই, সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব করে তুলতে পারে।
সূত্র: ‘Paper mill waste could unlock cheaper clean energy’ by Shenyang Agricultural University, 11th December 2025.
