বরফের উপর আমরা কখনও সাবলীলভাবে হাঁটাহাঁটি করি, আবার কখনও হড়কে পড়ি। এর মূল কারণ, বরফের উপরের অতি পাতলা জলীয় স্তর। বিজ্ঞানীরা মোটামুটি একমত যে এই তরলসদৃশ স্তরই বরফকে পিচ্ছিল করে তোলে। কিন্তু কেন এই স্তর তৈরি হয় সে বিতর্ক কয়েক শতাব্দী প্রাচীন।
ঐতিহাসিকভাবে তিনটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। প্রথমটি চাপ-গলন তত্ত্ব। উনিশ শতকে জেমস টমসন বলেন, বরফের উপর পা দিলে বা স্কেট চালালে চাপের কারণে বরফ গলে যায়। কিন্তু পরে গবেষণায় দেখা যায়, একজন মানুষের ওজন বরফ গলানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
দ্বিতীয়টি ঘর্ষণজনিত গলন। ১৯৩০-এর দশকে কেমব্রিজের গবেষকেরা বলেন, স্কেট বা জুতোর ঘর্ষণের ফলে তাপ তৈরি হয়, যা বরফ গলিয়ে, তার পিচ্ছিলতা বাড়ায়। যদিও এই ব্যাখ্যা পাঠ্যবইয়ে রয়েছে, কিন্তু অনেক বিজ্ঞানীর মতে এতে সমস্যা আছে। কারণ, বরফে পা রাখার মুহূর্তেই তা পিচ্ছিল, সেই মুহূর্তেই ঘর্ষণ থেকেই তাপ তৈরি হওয়ার কথা নয়। ঘর্ষণ থেকে তাপ সৃষ্টি হতে এবং তা থেকে বরফ গলতে যথেষ্ট সময় লাগে।
তৃতীয় ব্যাখ্যা হল, ‘পৃষ্ঠ-পূর্বগলন’। মাইকেল ফ্যারাডে লক্ষ্য করেছিলেন, বরফের পৃষ্ঠে এমনিতেই একটি পাতলা তরল স্তর থাকতে পারে। কারণ বরফের ভিতরের অণুগুলির তুলনায় পৃষ্ঠের অণুগুলি কম শক্তভাবে জমাট বাঁধে। এটি বেশি চলনশীল। আজ বিজ্ঞানীরা এই স্তরের অস্তিত্ব মেনে নিলেও, পিচ্ছিলতার জন্য এটি কতটা দায়ী, তা নিয়ে মতভেদ রয়ে গেছে।
স্পেনের পদার্থবিদ লুইস ম্যাকডাউয়েল ও তাঁর দল কম্পিউটার সিমুলেশনে দেখান, বাস্তবে এই তিনটি প্রক্রিয়াই একসঙ্গে কাজ করে। চাপ স্তরটিকে মোটা করে, উষ্ণ তাপমাত্রায় ঘর্ষণ তেমন ভূমিকা পালন না করলেও ঠান্ডায় তা গুরুত্বপূর্ণ হয়। তবে সম্প্রতি জার্মানির সারল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা দাবি করেছেন, এই তিন ব্যাখ্যাই অসম্পূর্ণ। তাঁদের মতে, খুব ঠান্ডাতেও বরফ পিচ্ছিল থাকে, এমনকি যখন কোনো জলীয় স্তর থাকার কথা নয় তখনও। তাঁরা একটি নতুন ধারণা দেন, অনিয়তকরণ ( ‘অ্যামরফাইজেশন’)। পিছলে পিছলে চলার সময় বরফের সুশৃঙ্খল কেলাস গঠন ভেঙে গিয়ে একটি বিশৃঙ্খল, তরলসদৃশ স্তর তৈরি হয়। এই কাঠামোগত পরিবর্তনই বরফকে পিচ্ছিল করে তোলে, বিশেষ করে নিম্ন তাপমাত্রায়। অনেক গবেষক এই নতুন ব্যাখ্যাকে সমর্থন করেছেন। তবে কেউ কেউ মনে করেন এটি উচ্চ গতির ক্ষেত্রেই বেশি প্রাসঙ্গিক। সব মিলিয়ে, বরফ কেন পিচ্ছিল, এই আপাত-সহজ প্রশ্নের উত্তর এখনও পুরোপুরি পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ও ব্যাখ্যার জটই হয়তো এই কয়েক শতাব্দী প্রাচীন সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানের পথে সবচেয়ে বড় বাধা।
সূত্র: Why Is Ice Slippery? A New Hypothesis Slides Into the Chat; Quanta Magazine, Dec 2025.
