স্টেরাইল নিউট্রিনোর ধারণা বাতিল

স্টেরাইল নিউট্রিনোর ধারণা বাতিল

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৫

বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত সব সময় নতুন কিছুর আবিষ্কার নাও হতে পারে। কখনও কখনও একটি জনপ্রিয় ও বহু আলোচিত ধারণার বিদায়ই গবেষণাকে নতুন বাঁক নেওয়ায়। তেমনই এক নাটকীয় অধ্যায়ের ইতি টেনেছে তথাকথিত স্টেরাইল নিউট্রিনো। এ এমন একটি কণা, যার পেছনে প্রায় এক দশক ধরে ছুটেছিলেন বিশ্বের সেরা পদার্থবিজ্ঞানীরা, অথচ শেষ পর্যন্ত তার অস্তিত্বই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এই চমকপ্রদ ফলাফল এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মিল্যাবের মাইক্রো বু এন ই (মাইক্রো বুস্টার নিউট্রিনো এক্সপেরিমেন্ট) প্রকল্প থেকে। নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, তাঁরা দশ বছরের তথ্য বিশ্লেষণের পর ৯৫ শতাংশ নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন—একক স্টেরাইল নিউট্রিনো নামক কোনো কণার অস্তিত্ব প্রকৃতিতে নেই। তরল আর্গনভিত্তিক বিশাল এক শনাক্তকারী যন্ত্র এবং দুটি শক্তিশালী নিউট্রিনো রশ্মিগুচ্ছ ব্যবহার করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেছে।
নিউট্রিনো অত্যন্ত ক্ষুদ্র ও প্রায় অধরা কণা। এতটাই ক্ষুদ্র ও নিঃস্পর্শ যে গোটা পৃথিবী ভেদ করেও প্রায় কোনো চিহ্ন রাখে না। প্রচলিত স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুযায়ী নিউট্রিনোর তিনটি ধরন রয়েছে—ইলেকট্রন, মিউঅন ও টাউ। এরা এক ধরনের নিউট্রিনো থেকে অন্যটিতে রূপান্তরিত হতে পারে, যাকে বলা হয় নিউট্রিনো দোলন। তবে অতীতের কিছু পরীক্ষায় এমন আচরণ দেখা গিয়েছিল, যা এই মডেলের পূর্বাভাসের সঙ্গে পুরোপুরি মেলেনি। সেই অমিল ব্যাখ্যা করতেই বিজ্ঞানীরা প্রস্তাব করেছিলেন নতুন এক চতুর্থ স্টেরাইল নিউট্রিনো কণার।
এই কণাটি যদি থাকত, তবে তা সাধারণ পদার্থের সঙ্গে কোনোভাবেই আন্তঃক্রিয়া করত না, শুধু মাধ্যাকর্ষণের মাধ্যমে প্রভাব ফেলত। ফলে একে শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি। মাইক্রো বু এন ই প্রকল্পের লক্ষ্যই ছিল এই কঠিন ধারণাটিকে কঠোর পরীক্ষার মুখোমুখি করা।
রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু মাস্টবাউম এই গবেষণাকে ক্ষেত্রটির জন্য একটি বড় বাঁক বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, তাঁরা একটি শক্তিশালী সন্দেহভাজনকে বাদ দিতে পেরেছেন, তবে রহস্য পুরোপুরি সমাধান হয়নি। অর্থাৎ, অস্বাভাবিক নিউট্রিনো আচরণের ব্যাখ্যা খোঁজার পথ এখনও খোলা।
এই গবেষণার গুরুত্ব শুধু একটি ধারণা বাতিলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর সবচেয়ে বড় দিক হলো—নিখুঁত উপাত্ত বিশ্লেষণ। নিউট্রিনোর সংখ্যা, তাদের পরমাণুর সঙ্গে আন্তঃক্রিয়া, কিংবা ডিটেক্টরের সূক্ষ্ম প্রতিক্রিয়া—সব ধরনের অনিশ্চয়তাকে হিসেবের মধ্যে এনে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন কীভাবে নির্ভুলতা অর্জন করা যায়।
স্টেরাইল নিউট্রিনো বাদ পড়ায় স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বাইরে নতুন পদার্থবিজ্ঞানের একটি সম্ভাব্য পথ বন্ধ হলো ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে আরও গভীর প্রশ্ন উন্মুক্ত হলো। এই উন্নত পদ্ধতি ভবিষ্যতের বিশাল প্রকল্প, যেমন-ডি ইউ এন ই (ডিপ আন্ডারগ্রাউন্ড নিউট্রিনো এক্সপেরিমেন্ট)–এর জন্য পথ প্রস্তুত করছে।
বিজ্ঞান সবসময় যে আবিষ্কারের আনন্দে এগোয় তা নয়, কখনও কখনও ব্যর্থতাই অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোকে আরও নিগূঢ় অর্থবহ করে তোলে।

সূত্র : Scientists spent 10 years chasing a particle that wasn’t there Materials provided by Rutgers University, Nature, 18th December 2025; 648 (8092): 64 DOI: 10.1038/s41586-025-09757-7.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

9 − 7 =