আরাবল্লি পর্বতমালার ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়

আরাবল্লি পর্বতমালার ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়

সুপর্ণা চট্টোপাধ্যায়
বিজ্ঞানভাষ সম্পাদকীয় বিভাগ
Posted on ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫

উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রাকৃতিক ইতিহাসে ‘আরাবল্লি’র স্থানটি অনন্য। প্রায় ৬৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পর্বতশ্রেণি দিল্লির কাছ থেকে শুরু হয়ে, দক্ষিণ-পশ্চিমমুখে হরিয়ানা ও রাজস্থান পেরিয়ে একেবারে গুজরাটের আমেদাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত। রাজস্থানের মাউন্ট আবুতে অবস্থিত গুরু শিখর (১,৭২২ মিটার) এই পর্বতমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ । ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসে আরাবল্লি ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন ভাঁজ-খাওয়া পর্বতমালা, যার জন্ম প্রায় ২০০ কোটি বছর আগে প্যালিওপ্রোটেরোজোয়িক যুগে।

এই প্রাচীন পাহাড়ঘেরা অঞ্চলকে নতুন করে সবুজ করার উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনার নাম “গ্রেট গ্রিন ওয়াল অব আরাবল্লি”। প্রস্তাবিত এই প্রকল্পে গুজরাট থেকে দিল্লি পর্যন্ত আরাবল্লি বরাবর ১,৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৫ কিলোমিটার প্রশস্ত এক সবুজ প্রাকৃতিক করিডর গড়ে তোলার কথা ভাবা হয়েছে, যা শিবালিক পর্বতমালার সঙ্গেও যুক্ত হবে। আগামী ১০ বছরে এখানে ১৩৫ কোটি দেশীয় গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। সাহারা মরুভূমিকে ঠেকাতে আফ্রিকায় যে ‘গ্রেট গ্রিন ওয়াল’ গড়ে তোলা হয়েছে, সেই আদলেই এখানেও প্রকৃতিকে ঢাল বানানোর এই চেষ্টা।

সরকারি হিসেব মতে, এই এলাকার দূষণের সবচেয়ে বড় অংশ, প্রায় ৫১% আসে আশপাশের শিল্পকারখানা থেকে। এর পরেই রয়েছে: যানবাহন থেকে ২৭%, খেতে ফসলের অবশেষ পোড়ানো থেকে ৮% এবং উৎসবের সময় আতশবাজি থেকে ৫% ।

কিন্তু এই সবুজ স্বপ্নের পাশেই দানা বাঁধছে তীব্র বিতর্ক। সরকার দাবি করছে, আরাবল্লির পরিবেশের ওপর “তাৎক্ষণিক কোনো বড় হুমকি নেই” এবং পাহাড়গুলি “মজবুত সুরক্ষার মধ্যেই রয়েছে”। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, খননকাজের অনুমতি দেওয়া হবে মোট এলাকার মাত্র ০.১৯ শতাংশে। আরাবল্লির বিস্তার ধরা হয়েছে ১.৪৪ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার।

বিতর্কের মূলে রয়েছে আরাবল্লিকে চিহ্নিত করার এক ‘নতুন সংজ্ঞা’। নতুন নিয়ম বলছে, স্থানীয় ভূমিতলের সাপেক্ষে যেসব স্থানের উচ্চতা কমপক্ষে ১০০ মিটার বেশি, সেগুলিকেই আরাবল্লি হিসেবে ধরা হবে। ঢাল ও সংলগ্ন জমিও এর মধ্যে পড়বে। দুটি পাহাড়ের দূরত্ব যদি ৫০০ মিটারের কম হয়, তবে মাঝের জমির উচ্চতা কম হলেও, সেটা আরাবল্লির অংশ বলে গণ্য হবে।

এই ‘সংজ্ঞা’ কিন্তু ভারতের বন সমীক্ষা সংস্থা (FSI)-এর বহুদিনের ‘৩ ডিগ্রি ঢাল সূত্র’-এর সঙ্গে মিলছে না। এই সংস্থা রাজস্থানের ক্ষেত্রে সমুদ্রপৃষ্ঠর সাপেক্ষে রাজ্যের সর্বনিম্ন উচ্চতা ১১৫ মিটার ধরে যেসব অঞ্চলের ঢাল ৩ ডিগ্রি বা তার বেশি, সেগুলিকে আরাবল্লি হিসেবে চিহ্নিত করে। নতুন ১০০ মিটার সংজ্ঞা প্রযুক্ত হলে রাজস্থানের বহু এলাকা তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাবে অথচ আরাবল্লির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই তো রাজস্থানের মধ্যে পড়ে।

ইতিমধ্যেই এর প্রভাব স্পষ্ট। গুজরাট, রাজস্থান, হরিয়ানা ও দিল্লি মিলিয়ে ৩৪টির বেশি জেলা, আরাবল্লির তালিকা বাদ পড়েছে। যেমন রাজস্থানের সওয়াই মাধোপুর। আরাবল্লি ও বিন্ধ্য পর্বতমালার মিলনস্থলে অবস্থিত রণথাম্ভোর টাইগার রিজার্ভও এখানে রয়েছে। তাছাড়াও বাদ পড়েছে চিতোরগড়। এখানেই আরাবল্লির শিলাস্তূপের উপর গড়ে ওঠা ইউনেস্কো স্বীকৃত বিখ্যাত দুর্গটি দাঁড়িয়ে আছে। এমনকি নাগৌর জেলার ১,১১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা আরাবল্লি হিসেবে চিহ্নিত ছিল, সেটিও নতুন সংজ্ঞায় নেই। সমালোচকদের মতে এটাই সব থেকে বিভ্রান্তিকর। এখানেই শেষ নয়। FSI-এর হিসেব অনুযায়ী, রাজস্থানের ১৫টি জেলায় আরাবল্লি বিস্তৃত ৪০,৪৮৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। নতুন সংজ্ঞা কার্যকর হলে পূর্ব চিহ্নিত পাহাড়, ঢাল ও সংলগ্ন এলাকার ৯৯% এরও বেশিই আর ‘আরাবল্লি’ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না।

পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, স্থানীয় ভূমির উচ্চতাকে ভিত্তি ধরলে বহু প্রকৃত পাহাড় সংজ্ঞার বাইরে চলে যাবে, বিশেষত যেখানে চারপাশের ভূমি তুলনায় উঁচু। এতে বেআইনি খননের সুযোগ বাড়তে পারে, প্রশ্ন উঠতে পারে প্রতিটি খনন ব্লকের পারিপার্শ্বিক প্রভাব নিয়েও। আর খননই তো শেষ কথা নয়। নগরায়ন, বাড়িঘর ও অবকাঠামো নির্মাণও পরিবেশকে বিপন্ন করবে। দিল্লি-এনসিআর অঞ্চলে, যেখানে আরাবল্লির শেষ প্রান্তের পাহাড়গুলির উচ্চতা কম, সেখানে এই ‘সংজ্ঞা’-ই বিস্তীর্ণ জমিকে ‘প্রাইম রিয়েল এস্টেট’-এ পরিণত করার দরজা খুলে দিতে পারে।

দুশো কোটি বছরের পুরোনো এই পর্বতমালার ভবিষ্যৎ তাই আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে সবুজ পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন আর অন্যদিকে নতুন সংজ্ঞার ফাঁকফোকর। এই টানাপোড়েনের মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে, প্রাচীন প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ- আরাবল্লি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fourteen − twelve =