ভাইরাস সংক্রমণের দ্রুত গতির রহস্য ভেদ

ভাইরাস সংক্রমণের দ্রুত গতির রহস্য ভেদ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৫

ভাইরাসকে আমরা এতদিন এক ধরনের নিখুঁত জ্যামিতিক সত্তা হিসেবে কল্পনা করে এসেছি। ক্ষুদ্র, সুশৃঙ্খল এবং প্রায় গাণিতিক নির্ভুলতায় গঠিত এক প্রোটিন খোলস, যার ভেতরে বন্দি থাকে তার জিনগত উপাদান। কিন্তু পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণা এই ধারণায় এক মৌলিক সংশোধন আনছে। তারা দেখিয়েছেন, ভাইরাসের প্রকৃত শক্তি এই নিখুঁত সমতায় নয়; বরং লুকিয়ে আছে এক ইচ্ছাকৃত অসমতায়, এক প্রায় অদৃশ্য ত্রুটিতে। যা সংক্রমণকে করে তোলে বিস্ফোরণের মতো দ্রুত।

গবেষণায় ব্যবহৃত হয়েছে টার্নিপ ক্রিঙ্কেল ভাইরাস (টি সি ভি) নমক একটি উদ্ভিদ ভাইরাস। এই উদ্ভিদ ভাইরাসটির খোলসের গঠন ২০ দিকবিশিষ্ট—যাকে বলা হয় আইকোসাহেড্রাল গঠন। এই গঠন বহু মানব ভাইরাস যথা- পোলিও, নোরোভাইরাস কিংবা হেপাটাইটিস বি ভাইরাস এবং চিকেনপক্সের ভাইরাসের সঙ্গে আশ্চর্যরকম সাদৃশ্যপূর্ণ। বাইরে থেকে এটি নিখুঁতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ মনে হলেও, ভেতরে রয়েছে মাত্র একটি ক্ষুদ্র রাসায়নিক বন্ধন, যার নাম আইসোপেপটাইড লিংক। এই একটি বন্ধনই ভাইরাসের ভেতরের ভারসাম্য বদলে দেয়।

এই ক্ষুদ্র বন্ধনটি ভাইরাসের দুইটি গাঠনিক প্রোটিনকে যুক্ত করে RNA-কে খোলসের একদিকে কেন্দ্রীভূত করে রাখে।

গবেষণার প্রধান লেখক গণেশ আনন্দ এই প্রক্রিয়াকে তুলনা করেছেন পাশার সঙ্গে। যেমন ওজন দেওয়া পাশা নির্দিষ্ট দিকেই বেশি পড়ে, তেমনি ভাইরাসের এই অসম গঠন নিশ্চিত করে যে সংক্রমণের সময় RNA নির্দিষ্ট একটি জায়গা দিয়েই বেরিয়ে আসবে। ফলে ভাইরাসের জিনগত উপাদান RNA সরাসরি পৌঁছে যায় পোষক কোষের প্রোটিন তৈরির কারখানায়, অর্থাৎ রাইবোজোমের কাছে। আর প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হওয়ার আগেই ভাইরাস নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে শুরু করে দেয়।

গবেষকেরা উন্নত প্রযুক্তি (যেমন ক্রায়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি এবং হাইড্রোজেন-ডিউটেরিয়াম এক্সচেঞ্জ মাস স্পেকট্রোমেট্রি) ব্যবহার করে ভাইরাসের জিনগত উপাদান উন্মুক্ত হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তটি ধরে ফেলতে সক্ষম হন। সেখানে একটি আধখানা খোলা ভাইরাস RNA যেন মুক্তির অপেক্ষায় কাঁপছে – যেন লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত। এই পর্যবেক্ষণ থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এটি শুধুমাত্র একটি উদ্ভিদ ভাইরাসের সুচতুর কৌশল নয়; অনেক মানব ভাইরাসই সম্ভবত একই ধরনের অসম গঠন ব্যবহার করে সংক্রমণের গতি বাড়ায়।

এই আবিষ্কারের গুরুত্ব চিকিৎসা বিজ্ঞানে সুদূরপ্রসারী। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, যদি এই অসমতার জন্য দায়ী আইসোপেপটাইড লিংককে নিশানা করে ওষুধ তৈরি করা যায়, তবে ভাইরাসের RNA মুক্তির প্রক্রিয়া ব্যাহত করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ, ভাইরাসের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র—তার দ্রুতগতির—বিরুদ্ধেই তাকে দাঁড় করানো যেতে পারে।

 

সূত্র: Unique bond identified as key to viral infection speed By Linda Stewart, 13th December 2025.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eight − 6 =