Truth is stranger than fiction.
আগে আগে ভাবতাম কথাটা অতিরঞ্জন। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে, বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে, দুনিয়াজোড়া খবর পড়ে আজকাল মনে হয় – নাঃ, কথাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অমুক ঘটনা কিন্তু গল্পকেও হার মানিয়ে যায়।
টার্জান দেখেছেন? বা, নিদেনপক্ষে ‘দ্য জাঙ্গল বুক’-এর মোগলি-কে তো দেখেইছেন। ছোটবেলায় দূরদর্শনে দেখাত। পরেও অন্যান্য চ্যানেলে দেখেছি। ‘ডিসনি’-র ফীচার ফিল্ম-ও আছে একই নামে। একজন মানবশিশু কী অনায়াসে এক নেকড়ে পরিবারের অন্তর্গত হয়ে জীবনযাপন করে। প্যান্থার, ভালুক, অজগরের সাথে তার কী প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ইত্যাদি। এটা গেল ‘ফিকশন’।
কিন্তু গোটা পৃথিবীতে ‘ফেরাল চাইল্ড’ বা ‘বন্য মানবশিশু’-র যে নজির পাওয়া যায়, সেটাই হল ‘স্ট্রেঞ্জার ট্রুথ’। কয়েক সপ্তাহ আগে, আমার ‘গুগল ফীড’-এ একটা ‘আর্টিকল’ আসে। ঘটনাটা প্রথমে সেখানে এবং পরে আরো অন্যত্র সবিস্তারে পড়ি। খুলেই বলি।
সেটা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ। ১৮৬৭ সাল। কিছু শিকারী উত্তর ভারতের বুলন্দশহরের জঙ্গলে গিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পায়। একটি নেকড়ের পিছনে একটি বাচ্চা ছেলে চার হাতে-পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। বিস্মিত হয়ে তারা তাকে উদ্ধার করতে চায় কিন্তু ছেলেটি তাদের নাগাল থেকে পালিয়ে যায়। এরপর শিকারীরা সেই নেকড়ের বাসস্থান খুঁজে বের করে এবং তার প্রবেশদ্বারের কাছে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া তৈরী করে। ধোঁয়ার তাড়নায় সেই নেকড়ে এবং নাবালকটি গুহা থেকে বেরিয়ে আসে।
শিকারীরা নেকড়েটিকে গুলি করে এবং বাচ্চাটিকে তুলে নিয়ে আসে আগ্রার সিকন্দ্রা মিশন অরফ্যানেজে। সেখানে তাকে দীক্ষিত করা হয়। ছ’ বছরের ছেলেটির নাম হয় দীনা শনিচর। সেই দিনটি ছিল শনিবার। তার থেকেই শনিচর (উর্দুতে শনিবার হল শনিচর)।
সেই থেকে দীনার নতুন ঠিকানা হয় সেই অনাথাশ্রম। মুশকিল শুরু হল এবার। এযাবৎ নেকড়েদের সাথে থাকার ফলে দীনার মধ্যে জান্তব আচরণ লক্ষিত হয়। সে হাঁটে চার হাতে-পায়ে। রান্না করা খাবারের বদলে সে কাঁচা মাংস খায় এবং মাংসের হাড় চিবিয়ে চিবিয়ে নিজের দাঁতে ধার দেয়। মানুষের কথা সে বুঝতে পারে না। উপরন্তু নিজেও নেকড়েদের মত মুখ উঁচু করে ডেকে ওঠে। জামাকাপড় পরার প্রতিও তার ঘোর অনীহা। বলা যায়, মানুষের সাধারণ প্রবৃত্তিগুলোই তার ভিতর অনুপস্থিত ছিল।
যেকোন সাধারণ শিশুর মানসিক বিকাশ ও যুক্তিবোধ তৈরী হওয়ার সাথে সাথেই সে কথা বলতে আরম্ভ করে, নিজের মনের ভাব অন্যের কাছে ব্যক্ত করতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু দীনার ক্ষেত্রে, তার জীবনের গঠনমূলক সময়টি নেকড়েদের সাথে অতিবাহিত হওয়ার ফলে তার মন ও বুদ্ধির বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
সেই অনাথাশ্রমে দীনা দীর্ঘ কুড়ি বছর কাটিয়েছিল। বহুদিনের চেষ্টায় সে দু’পায়ে হাঁটতেও সক্ষম হয়। কিন্তু মানুষের ভাষায় কথা বলার ক্ষমতা তার মধ্যে কখনোই তৈরী হয়নি। অথচ মজার ব্যাপার, মানুষের একটি গুণ, বা বলা যায় বদগুণ, সে আয়ত্ত করে। তা হল ধূমপান।
কিন্তু দীনার স্বভাবের কিছু উচ্চতর দিকও খুঁজে পান সেই আশ্রমের ফাদার এরহার্ট। সেই আশ্রমেই আরেকটি ‘ফেরাল চাইল্ড’-এর সাথে দীনার সখ্যতা ছিল। কাপ থেকে তরল পানীয় কিভাবে পান করতে হয়, তা দীনাই তাকে শেখায়। তার মধ্যে যে সহানুভূতি ও পরোপকারের গুণ বর্তমান, তা এর থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়।
দীনা ছাড়াও, ভারতে সেই সময় আরো কিছু জায়গাতে (এমনকি জলপাইগুড়িতেও) এরকম ‘ফেরাল চাইল্ড’-এর নিদর্শন পাওয়া যায়। এর একটা কারণ হতে পারে, অনেক সময়ই লোকালয় থেকে নেকড়ে মানবশিশু তুলে আনত খাবার হিসেবে। কিছু শিশু হয়ত ভাগ্যক্রমে বেঁচে যেত। তারা সেই নেকড়ে পরিবারেই রয়ে যেত এবং বলা বাহুল্য, তাদের হাবভাবই অনুকরণ করত। অবশ্য আগেই বলেছি, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তেই এরকম বিচ্ছিন্ন ঘটনার খোঁজ মিলেছে। শুধু নেকড়েই নয়, অন্যান্য পশুদের আশ্রয়ে থাকা শিশুর সন্ধানও পাওয়া গেছে। অনেকেই পরবর্তী কালে আবার মনুষ্যসমাজে ফিরে এসে সাধারণ জীবনযাপন করেছে।
কথিত আছে রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর বিখ্যাত বইয়ের অনুপ্রেরণা নাকি এই দীনা শনিচর। তা সত্যি না মিথ্যা জানা নেই, কিন্তু বাস্তব যে কল্পনাকে হার মানিয়ে যায়, তা নিয়ে আর কোন সন্দেহ নেই।
ছবি সৌজন্যঃ লিস্টোপিডিয়া