বিপন্ন রাজা
(এক কোটি বছর আগে ডোরাকাটা বিড়ালের জন্ম বৃত্তান্ত শুরু হয়। ক্রমশ ভৌগলিক বিস্তারের সঙ্গে বাঘ জঙ্গলের আধিপত্য কায়েম করে। আজ সেই ক্যারিশম্যাটিক প্রাণীটি বিলুপ্তির মুখে। বাঘের রাজকীয় বিস্তার ও বিবর্তনকে ফিরে দেখা নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ তৃতীয় কিস্তি।)
ভারতে বাঘের অনুপ্রবেশের সময়কাল নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও ভারতীয় সভ্যতায় বাঘের নিদর্শন খ্রিস্ট জন্মের তিন হাজার বছর আগেই স্পষ্ট। মহেঞ্জোদারো সভ্যতায় বাঘের গৌরবময় উপস্থিতি। মহেঞ্জোদারো খননে পাওয়া গিয়েছিল বাঘের প্রতিকৃতিসহ শিলাখণ্ড। একটি শিলাতে অর্ধেক নারী অর্ধেক বাঘের প্রতিকৃতি অন্যটিতে মাথা উল্টো এক বস্ত্রহীন নারীর একপাশে দুটি বাঘ। বাঘের অবস্থান মহেঞ্জোদারোতে পশুপতি হিসেবে সংস্কৃতে পশুপতির অর্থ পশুদের রাজা। বৈদিক যুগে বাঘ, নারীশক্তির প্রতীক হিসেবে কল্পিত। নয়ের শতকে তামিলনাড়ুতে উত্তমা চোলার রাজত্বকালের রৌপ্য খন্ডে বাঘের উপস্থিতি রয়েছে। বাঘের সঙ্গে ভারতিয়দের সুখস্মৃতি নিরবিচ্ছিন্ন না।
মোগল সাম্রাজ্যর সম্রাটরা বন্যপ্রাণ নিয়ে বিশেষ চিন্তার কোনো কারণ দেখেননি। সম্রাটদের রাজকীয় খানায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ রকমের মাংস। বন্যপ্রাণীদের মাংস বেশ জনপ্রিয়। আকবর শিকারের জন্য ট্রফি শুরু করতে দ্বিধা বোধ করেননি। জাহাঙ্গীর তার রাজত্বের প্রথম বারো বছরে ৮৬টি বাঘ ও সিংহ শিকার করেছিলেন। আর বাবরের বাঘ শিকার তো আজ রূপকথা। ১৭৫৭, পলাশীর যুদ্ধের পরে ইংরেজরা প্রত্যেক বাঘ শিকারের জন্যে পুরস্কার দিতে শুরু করেছিল আর ১৭৭০ শুরু হয় জঙ্গল কেটে কৃষিজমি বানানো যার ফলে নাগাড়ে মারা পড়তে থাকে জঙ্গলের প্রাচীন শিকারীরা। ব্রিটিশ সৈন্যদলের সদস্যরা নিয়মিত বাঘ শিকার করতে থাকে। স্থানীয় জমিদারদের থেকে ভাড়া নেওয়া হয় হাতি, সেই হাতির পিঠে চেপে ব্রিটিশ প্রভুরা অকাতরে বাঘ শিকার করে বেরিয়েছিল। খেতমজুররা ঢোল পিটিয়ে শব্দ করে বাঘকে ঘন জঙ্গল থেকে প্রান্তে তাড়িয়ে নিয়ে আসতো আর ব্রিটিশরা গাছের উপর বা হাতির পিঠ থেকে রাইফেল দিয়ে বাঘ শিকার করত। প্রায়শই পদাতিক সেই ক্ষেতমজুরদের বাঘের শিকার হতো। উল্টোদিকে ব্রিটিশরা লুকিয়ে বাঘ শিকারের পর, বাঘের মৃতদেহের সঙ্গে বীরত্বের চিত্র বাঁধিয়ে রাখতো। নিয়মখানা বানানো হয়েছিল বেশ খাসা, বাঘের গায়ে প্রথম গুলি যার বাঘের চামড়া তার। ১৯১১ সালে পঞ্চম কিং জর্জ নেপালের দশদিনে ৩৯ টিম বাঘ মেরে দর্প জাহির করেন। ভারতীয় মহারাজদের পারদর্শিতাও কম কি। ১৮৭৫ থেকে ১৯২৫, পঞ্চাশ বছরে ভারতবর্ষে আশি হাজার বাঘ মারা পড়েছিল। কোটার মহারাজ, রোলস রয়েস গাড়িতে বসালেন সার্চলাইট সঙ্গে একটি বিশেষ লান্টাকা বন্দুক, রাতে বাঘ শিকার করবেন। মধ্য ভারতের রেয়ার মহারাজা মারলেন ১০৯ টি বাঘ। মাইসোরের মহারাজের স্কোরশিটে একশোর উপরে বাঘ হত্যা। উদয়পুর আর গৌরীপুরের মহারাজের জোর টক্কর। দুজনেই যে পাঁচশোর উপরে বাঘ হত্যা করেছেন। জয়পুরের কর্নেল কেসরী সিং হাজার, সরগুজার রামানুজ সরেন সিংদেও এগারোশো। এতসব পরেও ১৯২৯ তে বোম্বেতে বাঘ ছিল। শুধু কি বোম্বে, দিল্লির যমুনা ও আগ্রার কাছেও বাঘের উপস্থিতি নথিভূক্ত আছে। ভারতীয় সভ্যতা, ধর্মীয় রীতিতে, পূরণের গল্পে বাঘের স্থান সর্বোচ্চ। দেবী জগদ্ধাত্রী তো শুধু বাঘ বাহন করেননি, শবরীমালা আয়াপ্পা এবং রাহু বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছে। পবিত্র বনবিবি সুন্দরবনের রক্ষক। বাঘ বনের পরিকল্পনা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ‘ভ্যালা বন’। ঐতিহাসিক নন্দিতা কৃষ্ণন মনে করিয়ে দিয়েছেন তামিলনাড়ুর আদি নাম পুলিয়ুর – বাঘেদের নগর। বাঘের স্বাস্থ্য ও সংকট বুঝতে সময় লেগে যায় স্বাধীনতার পরে আরও পঁচিশটি বছর। প্রায় আইসিইউ চলে যাওয়া বাঘকে প্রথম লাইফ লাইনটি দেন ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টার। (ক্রমশ)