সোশ্যাল নেটওয়ার্কে বাজিমাৎ পুং ডলফিনদের

সোশ্যাল নেটওয়ার্কে বাজিমাৎ পুং ডলফিনদের

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩১ আগষ্ট, ২০২২

একে অপরের সহায়ক হয়ে ওঠা, মনুষ্যজাতির এই সহজাত ক্ষমতা কীভাবে তৈরি হল? বহুদিন ধরেই নৃতত্ত্ববিদদের এই প্রশ্ন ভাবিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে আবার বিভ্রান্তও করে গেছে। পরিবার, কৌম, নগর, রাজ্য, জাতি বা জাতিসঙ্ঘের মতো মেলবন্ধনের কাঠামো সৃষ্টি করা – এ মানুষের বিশেষ প্রতিভা বটেই। শিম্পাঞ্জি আমাদের সবচেয়ে কাছের পূর্বপুরুষ নয়। তাদের মধ্যেও একে অপরকে নিয়ে নেটওয়ার্ক বানানোর অদ্ভুত দক্ষতা আছে। কিন্তু শেষ চার দশক ধরে গবেষকদের কাজে উঠে এলো অন্য আরেক প্রাণী যারাও এই একই কাজে বেশ পটু। বটলনোজ ডলফিন। এদের চলাফেরা মূলত ইন্দো-প্যাসিফিক জলভাগে, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার সার্ক উপসাগরে। বোতলের মতো নাকওলা এই ডলফিনদের ভালো নাম টারসিওপ্স অ্যাডাঙ্কাস।

বংশবিস্তারের সুযোগ বাড়ানোর মতলবে বটলনোজ ডলফিনেরা জোট বাঁধতেও ওস্তাদ। মনুষ্যপ্রজাতির বাইরের কোনও প্রাণী হিসেবে এরাই সবচেয়ে বড়ো আর জটিলতম দল তৈরি করতে পারে। নতুন এক গবেষণায় এই তথ্যই উঠে আসছে। মানুষের মতো নয়, এদের বিবর্তনের গতিপথও আলাদা ধাঁচের।

১৯৮২ সালে ডলফিন গোষ্ঠীর ভাবগতিক বোঝার কাজ শুরু করেছিলেন যারা, তাদের মধ্যে রিচার্ড কনোর অন্যতম। তিনি ফ্লোরিডা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বর্তমানে যুক্ত। ওনার গবেষক দল দুশোটারও বেশি ডলফিনকে নজরে রেখেছিল। সার্ক উপসাগরের যে দিকটায় জল খুব পরিস্কার, শুধু সেই অংশের ডলফিনদের নিয়েই ছানবিন চলছিল। কোন পুরুষ ডলফিন কাদের সাথে বেশি সময় কাটায়? চেনাশোনা সদস্যদের নিয়ে কীভাবে তারা অন্য ডলফিনদের দলে ভিড়ে যেতে পারে? ব্যাপারটা খানিক সৈন্যদলের মতো। এক পল্টন থেকে এক কোম্পানি, তারপর রেজিমেন্ট – ধাপে ধাপে ছোট থেকে বড়ো যোগাযোগ। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাইম্যাটোলজিস্ট (যারা বানর প্রজাতির প্রাণীদের নিয়ে গবেষণা করে থাকেন) রিচার্ড রাংহ্যাম সেনাদলের উপমাটা দিয়েছেন। প্রজননের জন্য উপযুক্ত সঙ্গিনী খুঁজতে এবং অন্য পুরুষের থেকে তাকে আগলে রাখতেই নাকি ডলফিনদের এই দলবাজি। ঐ আগলে রাখার কাজটা একা একটা পুরুষ ডলফিন করতে পারে না, তারও সাঙ্গোপাঙ্গ লাগে।

দু’হাজার এক থেকে ছয় সাল অবধি ১২১টা ডলফিনের ওপর নজরদারির পর বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলো নেড়েঘেঁটেই বিজ্ঞানীরা অবাক – ডলফিনদের এই অতি পরিণত জোট বাঁধার ক্ষমতা দেখে। যেখানে প্রত্যেকটা পুং ডলফিন সরাসরি বা বেপথে অন্যদের সাথে যুক্ত থাকে। তিনটে ধাপের ঐ দলের বাইরে গিয়েও একটা ডলফিন সংযোগ তৈরি করতে পারে। একেকটা পুরুষ ডলফিন গড়ে অন্য ২২টা পুং সদস্যের সাথে জোট করতে পারে, সর্বাধিক যা ৫০! এতে তাদের বংশবৃদ্ধির সুযোগ অনেকটা বেড়ে যায়।

কিন্তু নেটওয়ার্ক কীভাবে ঠিক তৈরি করে এই প্রাণী? পাশাপাশি সাঁতার কাটা, ডুব দেওয়া, একে ওপরের পাখনা ধরে খেলা করতে তাদের বন্ধুত্ব তৈরি হয়। তারপর প্রজননের সময় সাহায্য করা বা দূরে গেলে আওয়াজ করে ইশারা করা – এভাবেই দল বানায় পুরুষ ডলফিন। সঙ্গিনীকে অন্য কেউ নিয়ে পালাতে চাইলে বন্ধুর স্বার্থে তাকে উদ্ধার করা। স্বভাবতই যে দল যত বেশি শক্তিশালী এই নেটওয়ার্ক তৈরিতে, তারাই সবচেয়ে বেশি সময় কাটায় স্ত্রী ডলফিনদের সাথে। প্রফেসর কনোর এটাকে সুচিন্তিত সামাজিক সিদ্ধান্তের মতোই ভাবতে চান। আকারে বড়ো মগজের দৌলতে ডলফিনেরা বিপদের সময়কার বন্ধুকে চিনে রাখতেও জানে।

সহযোগের এই সহজাত ক্ষমতা প্রাণীজগতে বিরল নয়। পোকামাকড় থেকে শুরু করে সিংহ, নেকড়ে বা হায়নার কিছু প্রজাতিরও এই প্রতিভা আছে। শিম্পাঞ্জি বা বোনোবো নামের বানরপ্রজাতির প্রাণীও গোষ্ঠীর বাইরে বেরিয়ে বন্ধু বানাতে ওস্তাদ। কিন্তু অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির তাত্ত্বিক আথেনা আক্টিপিসের মতে, ডলফিনদের মতো বহু স্তরের দল তৈরি করার ক্ষমতা মানুষ ছাড়া আর কোনও প্রাণীর নেই। বড়ো আকারের মস্তিষ্ক এবং বুদ্ধিমত্তা কীভাবে এই জটিল সম্পর্ক তৈরি করতে পারে, সেটা বুঝতে এই গবেষণা বিশেষ সাহায্য করবে বলেই মনে করেন অধ্যাপক কনোর। সোশ্যাল ব্রেন হাইপোথিসিস বলে যে ধারণা বিবর্তন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আছে, সেখানেও ভাবনাচিন্তার পথ খানিকটা সুগম হবে।