মানুষের সাথে বাদবাকি প্রাণীর ফারাকের একটা বড়ো জায়গা ভাষা। পড়া, লেখা আর বলার ক্ষমতা আমাদের আছে। নানান উপায়ে অন্য মানুষের সাথে মনের বিভিন্ন ভাব অথবা চিন্তা বিনিময়ের জন্যে ভাষাই একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু এই প্রতিভা তো আর আকাশ থেকে পড়েনি। একদিনে হঠাৎ করে তৈরিও হয়নি। ভাষা সৃষ্টির জৈবিক ধাপগুলো কিন্তু এখনও ঠিক স্বচ্ছভাবে বুঝতে পারি না আমরা। জিনের যে একটা নিগূঢ় প্রভাব আছে তার আন্দাজ আগে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। দু’জন যমজকে নিয়ে বিখ্যাত এক পরীক্ষায় প্রমাণ হয়েছিল যে, লেখা বা পড়ার ক্ষমতার শতকরা ৩০ থেকে ৮০ ভাগ বংশগতির সৌজন্যেই।
নেদারল্যান্ডের নিজমেজেন শহরে অবস্থিত ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর সাইকোলিঙ্গুইস্টিক্স। প্রতিষ্ঠানের একদল গবেষক ভাষার উপর জিনের কেরামতি নিয়ে গবেষণা করছিলেন গত কয়েক বছর যাবৎ। সম্প্রতি তাঁদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হল প্রোসিডিংস অফ দ্য ন্যাশানাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস পত্রিকায়। হাজারের বেশি মানুষের জিন সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে সে এক বিশাল কর্মকাণ্ড। পাঁচটা ভাষাগত বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। জিনের গঠনের সাথে তাদের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ।
ফিনিশীয়, ফরাসি, জার্মান, হাঙ্গেরীয় আর স্প্যানিশ ভাষাভাষী ব্যক্তিরা সংখ্যায় কম ছিলেন এই গবেষণায়। বেশিরভাগ স্বেচ্ছাসেবকই ইংরেজিতে কথা বলেন। নানান ধাপের পরীক্ষা ছিল। সেগুলো বেশ মজারও। যেমন, প্রথমে পড়তে দেওয়া হয়েছে আসল কিছু শব্দ (যেমন – ময়ূর) আর আজগুবি বানানো কিছু ধ্বনি (যেমন – কপাম)। কোনও গোটা শব্দের একটা অক্ষর বাদ দিয়ে উচ্চারণ করতে বলা হয়। যেমন – কোলকাতা শব্দ থেকে ক বাদ দিয়ে বলার চেষ্টা করতে হবে। আবার শব্দবন্ধের ধ্বনি বিপর্যয় ঘটিয়ে সেটা উচ্চারণ করতে হবে, যেমন – ভালো থাকুন পাল্টে থালো ভাকুন।
ভাষাতত্ত্বের এই পরীক্ষার সঙ্গেই সমান্তরালে আরেকটা গবেষণা চলল জিন বৈচিত্র্য নিয়েও। দেখা গেছে, পয়লা নম্বর ক্রোমোজোমে DOCK7, ATG4C, ANGPTL3, USP1 নামের জিনগুলো শব্দ পড়ার ক্ষমতার সাথে যুক্ত। বলার দক্ষতা বা চিন্তাশক্তির উপরেও সাধারণ কয়েকটা জিনের বাটপাড়ি।
মস্তিষ্কের বিশেষ একটা অঞ্চল হচ্ছে সুপিরিওর টেম্পোরাল সালকাস। এর বামদিকের অংশটা খুবই জরুরী কথ্য বা লেখ্য ভাষার জন্যে। বানান করা, পড়া বা ধ্বনি চিনতেও সাহায্য করে মগজের এই এলাকা। গবেষণা থেকে উঠে আসছে আরেকটা দরকারি ব্যাপার। বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে মস্তিষ্কের উন্নতিতে নানান জিনগত বিক্রিয়া কীভাবে ভূমিকা পালন করে এসেছে।
কেন দুজন আলাদা মানুষের বলা, লেখা বা পড়ার ক্ষমতায় ফারাক থাকে? এমনকি একই সাংস্কৃতিক পরিবেশে থাকা সত্ত্বেও কেন এই বৈষম্য সৃষ্টি হয়? এসব প্রশ্নের সদুত্তরও এই গবেষণা থেকে পাওয়া যেতে পারে বলে আশাবাদী এলস এইজিং। উনি ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর সাইকোলিঙ্গুইস্টিকসের একজন বিজ্ঞানী। এই গবেশনাপত্রের অন্যতম পুরোধাও বটে।