সম্পাদকীয়
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান পত্রিকা চাই কেন ? নতুন ক’রে, নয়া আঙ্গিকে ! বেশ কিছুদিন ধ’রেই এই প্রশ্নটা নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোড়িত হয়েছি, চর্চা করেছি। প্রশ্ন করেছি– এ পত্রিকার প্রয়োজন কী ? বিশ্ব বিজ্ঞানের প্রতিদিন পালটাতে থাকা চেহারাটা আর চমক দেওয়া সব কর্মকাণ্ডের বাংলা ভাষায় ধারাবিবরণী দিয়ে গা গরম করার জন্যই এটা প্রয়োজন ? নাকি ঐতিহ্যের মর্মরধ্বনির সাথে বর্তমানের বাস্তবতার মিল হতে গিয়ে ব্যথা পাওয়া বাঙালি বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানভাবনাক্লিষ্ট মানুষজনের অভিমান ও অতৃপ্তি প্রকাশ করার জায়গা দেওয়ার জন্য তা দরকার ? বাংলা ভাষার নৌকাটা নাকি বিজ্ঞানের প্রবল স্রোতে টাল সামলে বাইতে পারেনি। চরে আটকেছে বারবার। নৌকায় জমেছে শ্যাওলা, চরে জন্মেছে দূর্বাঘাস। নৌকার যাত্রীরা উঠে গেছেন চাকচিক্যমন্ডিত সপ্তডিঙ্গা মধুকরে – ইংরাজি ভাষায়। এ কি বাংলা ভাষার দুর্বলতা ? নাকি আমরা যারা বিজ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করি, বিজ্ঞানী ব’লে পরিচিতি পাই- তাদের সত্তার দৃঢ়তা এবং নিজের ভাষার উপর ভরসার অভাবে ?
এ বিতর্ক চলতেই থাকবে- তেমনি চলতে থাকবে নতুন উদ্যোগও। ‘বিজ্ঞানভাষ’-এর ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তাই যথার্থই আমাদের শুনতে হয়েছে- নতুন পত্রিকার কী প্রয়োজন ? এও শুনতে হয়েছে পুরনো উদ্যোগগুলিকেও আরও উজ্জ্বল করতে মনোযোগী হওয়াটা আরও ফলপ্রসূ হতে পারে। অনেক সমমনস্ক শুভানুধ্যায়ী দীর্ঘশ্বাসের মেদুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে উচ্চারণ করেছেন- অনেক তো এরকম চর্চা দেখলাম ! ঐ আরকি ? দেখা যাক কতদূর যায় ! “হোক-হোক–দেখা যাবে !”
আমরাও বলি হোক দেখা যাক । তারপরে এও বলি ‘হবেই’ । নতুন প্রয়াস সবসময় বিষয়টির গতিময়তার ইঙ্গিত দেয়। তাতে পুরনো, সনাতন প্রবাহ পুষ্টি পায়। একে অন্যের পরিপূরক, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। বাংলাভাষায় বিজ্ঞান চর্চার আখড়া যত বাড়বে, বিজ্ঞান পিপাসুর সংখ্যাও বাড়বে তত, আগ্রহ তৈরির সাথে সাথে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের দৃশ্যমানতার ক্ষেত্র হবে ক্রমশঃ বিস্তীর্ণ। এতে বাংলার লাভ, লাভ বিজ্ঞানের।
প্রকৃতি আর জীবন নিয়ে নানান অবিন্যস্ত স্বপ্ন, ভেসে বেড়ানো ভাবনাকে নিবিড় পর্য্যবেক্ষণের ছাঁচে ফেলে পথ চলেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানী সুর ভাঁজেন, স্বরলিপিও বানান। কিন্তু তা আরও বেশি সংখ্যার মানুষের কাছে তাদের বোঝার মতো ক’রে পৌঁছতে না পারলে সেই সুর সীমাবদ্ধ থাকে। আর মানুষজনও বিজ্ঞানকে ভাবে বিজ্ঞানীদের সম্পত্তি- প্রতিদিনের জীবনের বিষয় নয়। বিজ্ঞানীকুলও সাধারণ মানুষের ভাবনা যে বিযুক্ত হয়ে এক হর্ম্যগৃহে দিন কাটান- যেখানে আত্মশ্লাঘা ক্রমশঃ তালহারানো আত্মপ্রচারে মুখ গোঁজে। বিজ্ঞানী যে আবেগে আর পরিশ্রম দিয়ে সূত্রনির্মাণ এবং জীবনকে আরও সুন্দর করার সামগ্রী বানিয়েছিলে- সাধারণ মানুষ তাকে দূর থেকে শ্রদ্ধা করে, সমীহ করে বেশি- নিজের ব’লে মনে করতে চায় না । কারণ সে বুঝে উঠতে পারে না যে এটা তার কল্যাণের জন্যেই।
‘বিজ্ঞানভাষ’ বাংলাভাষায় ভাবতে শেখা, বাংলা ভাষায় কথা বলা চল্লিশ কোটি জনসংখ্যার কাছে পৌঁছতে চায়- বিজ্ঞান ভাবনা নিয়ে। বিজ্ঞান শিক্ষা, বিজ্ঞান মনস্কতা আর বিজ্ঞান অভিক্ষা- শব্দগুলি শুনতে এক হলেও- সরলরেখায় হাঁটে না। এর অন্যতম কারণ নিজের ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা না করা। ছাপানো পত্রিকার চেনা অবয়বের বাইরে অক্ষর নির্ভর বৈদ্যুতিন চরাচর আমাদের সামনে নতুন ক্ষেত্র খুলে দিয়েছে।
আমরা সেখানে থাকতে চাই – মুক্ত প্রমিথিউসের মতো। আপনারা নজর রাখবেন। এই উদ্যোগে রাজ্য সরকারের উচ্চশিক্ষা দপ্তর প্রেরণা ও উত্তাপ জুগিয়েছে।
সমস্ত বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বিজ্ঞান ভাবনার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ হয়ে উঠুক ‘বিজ্ঞানভাষ’- এই কামনা করি।
_________________________________________________________________________________________________________________
॥ সভ্যতার কুশীলবদের কথা ও কাহিনী ॥
[ আসন্ন ১লা মে ২০২২ উপলক্ষে রচিত এই প্রতিবেদন ]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপান্তে একটি নতুন শব্দ উচ্চারিত হতে থাকে যার পোশাকী নাম “নয়া উপনিবেশবাদ” । এই নয়া উপনিবেশবাদেরই সন্তান “নয়া দাসত্ববাদ” । আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে শ্রমিক ও তার জন্য অনেক সুরক্ষার আইন আছে কিন্তু কার্যত সবই কুহেলিকা । আইন আছে, প্রয়োগ নেই । বিচার ব্যবস্থা আছে কিন্তু বিচার নেই । নয়া দাসত্ববাদের বে-আব্রু নগ্ন চেহারা বেরিয়ে পড়েছে করোনা আতঙ্কিত এবং তার পরবর্তী পৃথিবীর সর্বত্র ।ভারতবর্ষের মাটিতেও শ্রমজীবী মানুষের লাঞ্ছনার ছবি আজ সর্বত্র বিরাজমান । নয়া দাসত্ববাদের শৃঙ্খলিত শ্রমজীবী মানুষ ।
কেউ কথা রাখেনি – সর্বহারা পরিযায়ী শ্রমিক
মধ্য গগনে নিঃসঙ্গ সূর্যের কিরণ বর্ষার ফলকের মত নেমে আসছে রাস্তার ওপর, তারই মধ্যে হেঁটে চলেছে সন্তান কাঁধে নিয়ে সর্বহারা পরিযায়ী শ্রমিক । ২৪শে মার্চ ২০২০ করোনা আতঙ্কে কেন্দ্রীয় সরকার লক ডাউন ঘোষণা করল যার ফলে সমস্তরকম উৎপাদন প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে গেল । মুহূর্তের মধ্যে ভারতবর্ষের ক্ষেতে খামারে কলকারখানায় নির্মাণকার্যে বা খনিতে নিযুক্ত সমস্ত শ্রমিক কর্মহীন হল । আর এঁরা যাদের কাছে কাজ করতেন তারা সমস্তরকম দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে পরিযায়ী শ্রমিকদের খোলা আকাশের নীচে নামিয়ে দিল । তার পরের ইতিহাস এক মর্মান্তিক ইতিহাস । লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর, থাকার জায়গা নেই, নিজেদের সামান্য সম্বল নিয়ে নিজেদের বাসস্থানে ফেরার জন্য ব্যাকুল কিন্তু রাজ্য বা কেন্দ্রের হিমশীতল নীরবতা পরিযায়ী শ্রমিকদের আর বঞ্চনাকে কেবলমাত্র প্রলম্বিতই করল ।
এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে শ্রমিক নিয়ে যাওয়া ভারতের ইতিহাসে কোন নতুন ঘটনা নয় । এমনকি পৃথিবীর ইতিহাসেও দাসব্যবস্থা বা ক্রীতদাস প্রথা হল আজকের পরিযায়ী শ্রমিকদের আদিম অবস্থা । পৃথিবী জুড়ে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে চালু রাখতে এক দেশ থেকে অন্য দেশে জোর করে শ্রমিক নিয়ে যাওয়া নতুন কোন ঘটনা নয় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ অন্তর্গত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা তৈরী হয় এবং এই আন্তর্জাতিকশ্রমিক সংস্থা পৃথিবী জুড়ে শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য একটি সনদ তৈরি করেন এবং পৃথিবীর সমস্ত দেশকে এই সনদ অনুযায়ী শ্রমিক কল্যাণের জন্য আইন তৈরীর উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলা হয় । স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষের বুকেও কমপক্ষে ৪৪টি আইন তৈরী হয় শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য । পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্যও আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমজীবী আইন ১৯৭৯ সালে তৈরী হয়, যে আইনে সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে রাজ্যের কোন শিল্প বা কলকারখানায় অন্য রাজ্যের শ্রমিককে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করলে শ্রম দপ্তরের অনুমতি নিতে হবে । কিন্তু আইন সৃষ্টি হবার পর ৪১ বছর অতিক্রান্ত কিন্তু আজও কোন রাজ্য বা কেন্দ্রের কাছে পরিযায়ী শ্রমিকের সুনির্দিষ্ট সংখ্যাতত্ত্ব নেই । আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমজীবী আইনে শ্রমিকদের ন্যয্য মজুরী, তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার বন্দোবস্ত সহ তাদের সুরক্ষার কথা বলা আছে । কিন্তু বাস্তবে পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কোন বন্দোবস্তই নেই । ২০১৩ থেকে চন্দননগরের আইনী সহায়তা কেন্দ্র পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর একটি সমীক্ষা চালান । তাতে দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গে কারখানা, ইটখোলা বা খনি শিল্পে নিযুক্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের কোন পরিসংখ্যান নেই । অবশ্য এই অবস্থা প্রায় সমস্ত রাজ্যেই । কেবলমাত্র কেরলে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কমবেশী প্রশাসনিক তৎপরতা বর্তমান । এই ব্যাপার নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে কয়েকদফায় আইনী নোটিশ দিলে কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত রাজ্যে আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমজীবী আইন লাগু করার কথা বললেও তা কার্যকর হয়নি । বিপর্যস্ত করোনা পরিবেশে পরিযায়ী শ্রমিকদের চরম দুরবস্থা প্রমাণ করল আইন থাকলেও তাকে কার্যকরী করার ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর তরফে কোন উদ্যোগ নেই । সম্প্রতি অনেক রাজনৈতিক দলই এই ব্যাপার নিয়ে অনেক বিবৃতি দিচ্ছেন কিন্তু এই সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি কোন না কোন সময়ে কেন্দ্রের ক্ষমতায় ছিলেন কিংবা রাজ্যের শাসক দলের ভূমিকা পালন করেছেন । তখন কারোর মনে হয়নি আইনটি কার্যকরী করতে হবে ।
ফলতঃ ভারতবর্ষ জুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকের দল বেঁচে থাকার তাগিদে কয়েকশো মাইল অতিক্রম করে ঘরে ফেরার চেষ্টা করেছেন । রাজপথে নিরন্ন হতাশাগ্রস্থ এই মানুষের দাবি সম্ভবতঃ এর আগেও ভারতবর্ষের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় । ছিন্নমূল মানুষের সেই পথচলার ছবি আরো একবার ফুটে উঠেছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘিরে । ভারতের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা তথা উৎপাদন প্রক্রিয়ার মালিকরা যথেষ্টই অবগত আছেন এই পরিযায়ী শ্রমিক না থাকলে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা থমকে যাবে আর শ্রমিকরাও জানেন, গ্রামে তাঁদের কাজ নেই, কাজের প্রয়োজনে তাঁদের আবার ফিরতে হবে হয়তো অন্য কোন রাজ্যে । একবিংশ শতাব্দীর নয়া দাসত্ববাদের শৃঙ্খলে ওরা আবদ্ধ । উত্তরণের পথ ওদের জানা নেই, তবু জীবনযুদ্ধের ওরা অপরাজেয় সৈনিক । ওরা কাজ করে নগরে বন্দরে । ২০২০ র পর কেটে গেছে অনেকটা সময় । …
সংগঠিত শিল্পের শ্রমিক – এক বঞ্চনার অধ্যায়
ভারতবর্ষের শ্রমজীবী মানুষের কেবলমাত্র ৫ থেকে ৬ ভাগ সংগঠিত শিল্পের সঙ্গে যুক্ত । সংগঠিত শিল্প বলতে আমরা বুঝি শ্রমিক আইন অনুযায়ী যে সমস্ত উৎপাদন প্রক্রিয়া কলকারখানা হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে অর্থাৎ একই ছাদের তলায় বা সংস্থায় কমপক্ষে ১০জন শ্রমিক কাজ করে । পশ্চিমবঙ্গের বুকে সর্ববৃহৎ সংগঠিত শিল্প পাটশিল্প ও চা শিল্প এবং তারপরেই চর্মশিল্প, লৌহ-ইস্পাত শিল্প, কয়লাশিল্প সহ বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প । করোনা বিপর্যয়ের পরেই কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার ঘোষণা করেন যে প্রত্যেক শিল্প সংস্থাকে তার শ্রমিকদের বেতন দিতে হবে । কিন্তু কার্যতঃ কেন্দ্র বা রাজ্যের এই নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মালিকরা বেশ ভালো-ই সময় কাটাচ্ছেন কারণ পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের শিল্প মালিকরা জেনে গেছেন, ভারতের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাতে যত আইনই থাকুক না কেন সেই আইন না মানলে মালিকের কোন সমস্যা নেই ।
করোনা অতিমারির সময়ে উৎপাদন প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল এবং সেই সুযোগ নিয়ে মালিকরা সবরকম সরকারী নির্দেশকে অমান্য করে বেতন দেওয়া বন্ধ রেখেছলেন । বিভিন্ন জুটশিল্প, হোসিয়ারী শিল্প ও বেসরকারী কারখানার মালিকরা বেতন দেননি । এ ব্যাপারে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও আইন সহায়তা কেন্দ্র শ্রমদপ্তরের কাছে মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানিয়েছিলেন কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে একটি কারখানার মালিকের বিরুদ্ধেও প্রশাসন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি । মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার রাষ্ট্রীয় চরিত্র নতুন কোন ঘটনা নয় । প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য কেবলমাত্র জুটশিল্পেই অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের প্রায় সাড়ে চারশো কোটি টাকা গ্র্যাচুইটি পাওনা শ্রমিকদের । কিন্তু বিগত দশ বছরের মধ্যেও একজন মালিকের বিরুদ্ধেও শ্রমদপ্তর আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি । শ্রমিক ছাঁটাই, অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আত্মসাৎ করা এতো নিত্যদিনের ঘটনা । কিন্তু বিগত দশ বছরের মধ্যে একজন মালিকও শ্রমিকের টাকা আত্মসাৎ করার জন্য জেলে যাননি । কিছু কিছু ক্ষেত্রে শ্রমিকরাই বাধ্য হয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই হাইকোর্টের নির্দেশে কতিপয় শ্রমিক হয়তো টাকা আদায় করতে সমর্থ হয়েছেন । কিন্তু সে সংখ্যা বড়ই নগণ্য ।
করোনা জনিত অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে উত্তরণের দোহাই দিয়ে বেশ কয়েকটি পরিবেশ এবং শ্রম আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে । একথা অনস্বীকার্য যে ফলশ্রুতিতে অন্ততঃ আইনগতভাবে শ্রমিকদের অবস্থান পূর্বের চেয়ে আরও বেশ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে । কতখানি কার্যকরী হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এর আগে অন্ততঃ আইনগুলি ছিল । এখন পরিস্থিতি শ্রমিকদের দিক দিয়ে আরও অনেকবেশি সংকটজনক ।
বিশ্বব্যাপী মন্দার চাপে সংগঠিত শিল্পের কি অবস্থা হবে কোন অর্থনীতিবিদই সঠিকভাবে অনুমান করতে পারছেন না । অর্থনীতিবিদদের মধ্যে কথাবার্তা চলছে । কিন্তু প্রশ্নটা হল রাষ্ট্র কি তাঁদের কথা শুনবে না ধর্মীয় ভাবাবেগে ভেসে রাষ্ট্র চালানোর উদ্যোগ নেবে অথবা প্রচার সর্বস্ব নীতির মধ্যেই চলতে থাকবে ! প্রকৃত সমাধান অর্থনীতিবিদরা হয়তো দিতে পারেন কিন্তু এখন দেখার, রাষ্ট্র তাকে গ্রহণ করে কিনা । তবে একথা ঠিক পৃথিবী জুড়ে যে হাহাকার তৈরী হয়েছে তার যদি সুষ্ঠু সমাধানের পথে রাষ্ট্র অগ্রসর না হয় তবে প্রলয় অবশ্যম্ভাবী কারণ মনে রাখা দরকার ক্ষুধা কোন আইন মানে না !
অসংগঠিত শ্রমিক – অনিশ্চয়তার যাত্রী
ভারতবর্ষের শ্রমজীবী মানুষের প্রায় ৯৫ ভাগই অসংগঠিত শ্রমিক যারা প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় । যাদের আমরা দেখেও দেখি না, যাদের কথা আমরা ভুলেও ভাবি না । আমাদের বাড়ির গৃহ-পরিচারিকা, বাড়ির সাফাইকর্মী, কুড়ানি, নির্মাণ শ্রমিক, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, মুটিয়ামজদুর, ড্রাইভার, খালাসী, ধোপা, নাপিত সহ অসংখ্য পেশায় হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষ নিযুক্ত । আমাদের জীবনের সুখ দুঃখতে ওরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত । ওদের না আছে নিয়োগপত্র, না আছে ভবিষ্যতের দিশা । যতদিন গতর চলে ওরা খেতে পায় তারপর দাঁড়িয়ে থাকে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় । চিকিৎসার কোন সুযোগ নেই । বড় জোর সরকারী হাসপাতালের বিনামূল্যের বেডে শুয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় থাকে । করোনা ভাইরাসের সময়ে এরা সর্বাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছিল । এদের কে বেতন দেবে ? কারণ এদের কোন সুনির্দিষ্ট মালিক নেই । না আছে কোন নির্দিষ্ট সংস্থা যেখানে গিয়ে ওরা বেতন চাইতে পারে । সরকারের বহুবিধ নির্মাণকাজে অথবা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের নির্মাণের সঙ্গে ওরা যুক্ত । এঁদের সকলেরই অবস্থা একইরকমের সংকটজনক । ফলতঃ ভারতবর্ষের প্রায় ৯৫ভাগ শ্রমিক এক নিদারুণ অনিশ্চয়তার শিকার । অতিমারির সময়ে এঁদের বিষয় নিয়ে কয়েকটি আবেদনপত্র সরকারী দপ্তরে জমা পড়েছিল আর্থিক অনুদানের জন্য কিন্তু বিশেষ কোন সরকারী উদ্যোগ চোখে পড়েনি । অসংগঠিত শ্রমিকরা তাকিয়ে থাকেন বড় বড় হোর্ডিংয়ের দিকে যেখানে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় সরকার সর্বদা শ্রমিকের পাশে । এক চরম লাঞ্ছনা আর বঞ্চনা নিয়েই এদের চলতে হচ্ছে । এখন এদের ভরসা কেবলমাত্র ভিক্ষাপাত্র, কখন কে কোথায় ত্রাণ দিচ্ছে তার জন্য দৌড়ে বেড়াচ্ছে । বড় কঠিন সময় । এক অদ্ভুত আঁধার নেমে এসেছে এই শ্রমিকদের ভবিষ্যতে ।
সর্বশেষে আবার সেকথাই বলতে হয়, নয়া দাসত্ববাদের যুগে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় শ্রমিক স্বাধীন কিন্তু কার্যতঃ সে সমাজের একটি শ্রেণীর কাছে শৃঙ্খলিত ও আবদ্ধ । এই শৃঙ্খলকে কেউ দেখতে পায়না কিন্তু শ্রমিক অনুভব করে তন্তুতে তন্তুতে । তবু জেগে থাকে আশা । শৃঙ্খল ভাঙার আশা স্পন্দিত হয় শ্রমিকের বুকে । কবিগুরুর আশা ধ্বনিত হয় আমাদের বুকে – “নিদ্রিত ভারত জাগে” । একই সুরে আমরাও বিশ্বাস করি – “দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে”
_________________________________________________________________________________________________________________
ফিরবে কি সরস্বতী
বিগত প্রায় ২০ বছর ধরে দক্ষিণবঙ্গের পরিবেশকর্মীরা প্রায় মজে যাওয়া সরস্বতী নদীর সংস্কার নিয়ে আবেদন নিবেদন আন্দোলন করে আসছেন । সম্প্রতি একটি জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে সরস্বতী নদীর সংস্কার নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে । আমরা স্বভাবতই খুশি কিন্তু একইসাথে কিছুটা আশঙ্কিতও বটে । কেননা আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এ দেশে কমিটি গঠন করে আসলে অনেকসময়ই মূল সমস্যাটিকে ধামাচাপা দেবার প্রচেষ্টা করা হয়ে থাকে মাত্র । গঙ্গা দূষণ নিয়ে কমিটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সেই কমিটি যে যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তার প্রায় কোনকিছুই গৃহীত হয়নি বা সেই সব প্রস্তাবের ভিত্তিতে কোনোরকম কাজ হয়নি । পূর্ব কোলকাতার জলাভূমির সমস্যা নিয়ে গঠিত কমিটি এবং তার প্রস্তাবগুলি নিয়েও আমাদের একই রকমের করুণ অভিজ্ঞতা । এইসব কারণেই সরস্বতী নদী নিয়ে গঠিত কমিটি প্রকৃতপক্ষে ঠিক কতোখানি কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারবে সেই নিয়ে একটা আশঙ্কা থেকেই যায় । সরস্বতী নদী দক্ষিণবঙ্গের দুটি জেলা হুগলী এবং হাওড়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত । কিছুদিন আগে সরস্বতী নদীর হৃত স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্য নিয়ে কোন কোন স্থানে কিছু কিছু খননকার্য শুরুও হয়েছিল । সেসব কাজ বন্ধ হয়ে গেছে এবং যে সকল স্থানে খননের কাজ চালানো হয়েছিলো সেইসব জায়গায় নতুন করে আবর্জনা ফেলে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে । সত্যি কথা বলতে কি গোটা যাত্রাপথ জুড়েই নদীটি একটি আবর্জনা ফেলার জায়গায় রূপান্তরিত হয়েছে । বেআইনি বসতবাড়ি দোকানঘর ইত্যাদি তো আছেই । একসময়ে এই সরস্বতী নদীর উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল কতো জনপদ । আশা করছি গঠিত কমিটি সঠিকভাবে এই নদী সংক্রান্ত সকল সমস্যা, তার কারণ এবং একইসাথে সেই সমস্যা দূরীকরণের সকল উপায় প্রস্তাবাকারে সরকারের সামনে উপস্থিত করবেন এবং সরকারও সর্বান্তকরণে সেই প্রস্তাবগুলি কার্যকর করার জন্য সকলপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন ।
————————————————————————-
কুড়ানি – ওরাও মানুষ
পশ্চিমবঙ্গের বুকে ৫টি পৌরনিগমে নির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে ও নতুন বোর্ড গঠিত হয়েছে ।রবিবার আরও ১০৮ টি পৌরসভাতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে । সমস্ত পৌরনিগমে অন্যতম সমস্যা কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা । প্রত্যেকটি শহর তথা কোলকাতার দিকে তাকালে দেখা যাবে বর্জ্যের পাহাড় । আর এই বর্জ্যের পাহাড়ে কি না নেই ! প্লাস্টিক, ছোট ছোট ফেলে দেয়া ব্যাটারি, বিভিন্ন বাড়ি বা হোটেল থেকে ফেলে দেয়া বর্জ্য সহ নানাবিধ ফেলে দেয়া ওষুধ আর ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ।
১৯৮৬ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অন্তর্গত ২০০০ সালে কঠিন বর্জ্য বা কঠিন পৌরবর্জ্য সংক্রান্ত নিয়মাবলী ভারত সরকার প্রকাশিত করেন । এই দীর্ঘ ২২ বছরের মধ্যে বেশ কয়েকবার পৌর নির্বাচন হয়ে গেল এবং নির্বাচনের সময় সমস্ত রাজনৈতিক দলই ইস্তাহার প্রকাশ করলেন, যে ইস্তাহারে ভাসা ভাসা পরিবেশ বিষয়ক কথা উচ্চারিত হয়েছে । কিন্তু একবারও বলা হল না দীর্ঘ ২২ বছরের মধ্যে কঠিন পৌরবর্জ্যের ব্যবস্থাপনা কেন হল না । অথচ আমরা প্রত্যেকে আমাদের বাড়ির বর্জ্য পদার্থ বা আমাদের ফেলে দেয়া অপ্রয়োজনীয় অসংখ্য জিনিষ ক্রমাগত ডাস্টবিনে ফেলে দিই এবং পৌরসংস্থা মাঝে মাঝে গাড়ি করে এসে আমাদের ফেলে দেয়া বর্জ্য তুলে নিয়ে চলে যায় । সাম্প্রতিককালে বাড়ি থেকে পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্যকে পৃথকভাবে তুলে নেবার জন্য গাড়ি করে লোক আসছে । এই উদ্যোগ নিশ্চয়ই অভিনন্দনযোগ্য । কিন্তু এদের বাইরেও এমন কিছু পুরুষ, মহিলা ও শিশু আছে যারা আমাদের ফেলে বর্জ্য সংগ্রহ করেন এবং সেই বর্জ্য থেকে সম্পদ তৈরির প্রক্রিয়াকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন । এঁরা প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ান, পরনে নোংরা জামাকাপড়, পায়ে জুতো নেই, হাতে গ্লাভস্ নেই, মুখে নেই কোন আচ্ছাদন । এঁদেরই চলতি নাম কুড়ানি । এঁরা প্রত্যেকেই প্রান্তিক ঘরের নেই রাজ্যের মানুষ । এঁদের বাসস্থান রাস্তার ধারে বা কোন বস্তিতে বা রেললাইনের ধারে । সকাল থেকেই এঁদের দেখা মেলে আস্তাকুঁড়ে, নালা-নর্দমায় । রাস্তা থেকে এঁরা কাগজ, প্লাস্টিক, শিশি বোতল সহ নানা ভাঙাচোরা জিনিষ সংগ্রহ করে ঝোলায় ভরেন । দিনান্তে পরিতক্ত জিনিষগুলো নিয়ে ওঁরা চলে যান । বিভিন্ন বর্জ্য সংগ্রহকারী ব্যক্তি বা সংস্থার কাছে তাঁরা পৌঁছে যান এবং সামান্য অর্থের বিনিময়ে সংগৃহীত বর্জ্য বিক্রয় করতে বাধ্য হন । এই কুড়ানিদের একটা বড় অংশ মহিলা বা শিশু যাঁদের পেটে ক্ষুধার আগুন আর সেই আগুন নেভাতে ওঁরা নির্দ্বিধায় নেমে পড়েন নর্দমা বা ডাস্টবিনের ভিতর । ডাস্টবিনের ময়লার মধ্যে দাঁড়িয়েই খুঁটে খুঁটে বের করেন তার মধ্যে থেকে কোনগুলিকে বিক্রয় করলে অর্থ পাওয়া যাবে । এই বর্জ্য থেকে জিনিষপত্র বের করার সময়ে ওঁদের হাত ক্ষতবিক্ষত হয়, কিন্তু থেমে থাকলে ওঁদের চলবে না কারণ পেটের জ্বালা বড় জ্বালা । সমগ্র ভারতবর্ষে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তথা শহর পরিষ্কার রাখার ক্ষেত্রে এই কুড়ানিদের অবদান এক অনুচ্চারিত সত্য । রাজ্যে ‘সবুজ শহর’ পরিকল্পনা আরম্ভ হয়েছে যার অন্যতম উদ্দেশ্য শহরকে পরিবেশ-বান্ধব হিসাবে গড়ে তোলা । শহরকে পরিবেশ-বান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে গেলে কঠিন বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত আবশ্যিক এবং এই আবশ্যিক কাজটির ক্ষেত্রে কুড়ানিদের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় কুড়ানিদের সম্পর্কিত ভাবনা ব্রাত্য । এমনকি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারে যে কর্মসূচি প্রকাশিত হয়েছে তাতে এই হতভাগ্য কুড়ানিদের ব্যাপারে একটি শব্দও ব্যবহৃত হয়নি ।
কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আইনে এই কুড়ানিদের কথা কিন্তু উল্লেখিত হয়েছে । আইনে সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে রাজ্যস্তরে বর্জ্য বিষয়ক উপদেষ্টা মন্ডলীতে কুড়ানিদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে । আইনে আরও বলা আছে স্থানীয় প্রশাসন বর্জ্য কুড়ানিদের স্বীকৃতি দেবেন এবং তাঁরা যাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চক্রের অন্যতম কুশীলব হিসেবে পরিগণিত হন সেই নির্দেশিকা জারি করবেন । বর্জ্য কুড়ানিদের পরিচয়পত্র থাকবে । প্রয়োজনবোধে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন করে এঁদের উৎসাহ দিতে ও সহায়তা করতে হবে । আইনে যাই লেখা থাকুক বাস্তবে এঁরা আমাদের ভাবনার পরিমন্ডলের মধ্যে আসেন না । নির্বাচন আসে নির্বাচন যায় । দরিদ্র মানুষদের জন্য ভাবনাচিন্তায় অস্থির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সদর্পে প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন, জনগণ হাততালি দেয় । আর আমাদের হতভাগ্য কুড়ানিরা ঘিঞ্জি বস্তিতে বা রেললাইনের ধারে আলোহীন জলহীন ভাঙাচোরা ঘরে কোনরকমে রাত কাটান আর সকাল হলেই ভোরের সূর্য্যকে সাক্ষী রেখে বেরিয়ে পড়েন আমাদের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট সংগ্রহে । ওঁরাই আমাদের জীবনযাত্রার ভ্যাকুয়াম ক্লীনার । আগামীদিনে এই কুড়ানিদের ভাগ্যাকাশে কোন সুস্থতা আসবে কিনা তা ভবিষ্যৎই বলবে ।
________________________________________________________________________________________________
ব্রাত্যই থেকে গেল পরিবেশ
প্লাস্টিক বর্জন ও পাটশিল্প
গতকাল সংসদে পেশ করা হল আগামী আর্থিক বছরের জন্য কেন্দ্রীয় বাজেট । আমাদের সব আশা-আকাঙ্খাকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে বিগত বছরগুলির মত এই বাজেটেও ব্রাত্যই রয়ে গেলো পরিবেশ ভাবনা । সমগ্র বিশ্ব যখন প্লাস্টিক বর্জনের কথা বলছে তখন সেই পথে হাঁটার কোনরকম আগ্রহই দেখা গেল না আমাদের কেন্দ্রীয় বাজেটের পাতায় । একটি শব্দও উচ্চারিত হল না প্লাস্টিকের বিকল্প হিসাবে পাটশিল্পকে উৎসাহ প্রদানের বিষয়ে । পরিবেশ বান্ধব পাট কেবলমাত্র প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে উঠেই আসতে পারে তা নয় মনে রাখতে হবে এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত আছেন প্রায় ২ লক্ষ শ্রমিক । পাটচাষের সঙ্গে যুক্ত আরও দশ লক্ষাধিক কৃষিজীবী পরিবার । পাটশিল্পকে উৎসাহ দিলে এই মানুষগুলির জীবন জীবিকা সংক্রান্ত সমস্যারও একটা সমাধান বেরিয়ে আসতে পারত । এঁদের হাতে অর্থ এলে বাজারে চাহিদা সৃষ্টিতেও একটা সদর্থক প্রতিক্রিয়া দেখা যেত ।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
যে কোন আধুনিক জনপদের প্রাথমিক শর্ত হল একটি বৈজ্ঞানিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা । এই বিষয়টিতেও এই কেন্দ্রীয় বাজেট কোনোরকমের দিশা দেখাতে ব্যর্থ । আমাদের দেশে সম্ভবতঃ এমন একটি শহরও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে একটি বিজ্ঞানসম্মত বর্জ্য ব্যবস্থা বলবৎ আছে । এদিকে বড়ো মুখ করে বলা হচ্ছে ডিজিটাল ইন্ডিয়া-র কথা, বলা হচ্ছে নির্মল সবুজ শহরের কথা কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না । বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি যুক্ত তাও বাজেট প্রণেতারা এইদিকে কাম্য নজরটুকু দেননি ।
নদী ও জলাভূমি সংরক্ষণ
নজর দেওয়া হয়নি নদী নাব্যতার দিকেও । নদীগর্ভে পলি জমে জমে বছরের পর বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যার মত ঘটনা ঘটে চলেছে । মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছেন তৎসত্বেও অবহেলিত থেকে গেল নদীর নাব্যতা রক্ষার বিষয়টি । বিশেষ করে এই রাজ্যের গঙ্গা ভাঙন এক বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে যাওয়া সত্বেও সেই ভাঙন রোধে কোনোরকম পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা ঘোষিত হয়নি এবারের বাজেটে । নদীমাতৃক এই দেশের সভ্যতার অগ্রগতি অনেকাংশেই নির্ভরশীল নদী ও তার নাব্যতার উপর । খাতাকলমে তৈরি “নমামি গঙ্গে” প্রকল্প বন্দী হয়ে পড়ে আছে সেই খাতাকলমেই, কাজের কাজ কিছুই হয়নি । মঝে মধ্যে শাসকদলের নেতৃত্বকেও দেখা যায় যজ্ঞের কাঠ ভস্ম ইত্যাদি নদীর জলে নিক্ষেপ করে সেই জলকে কলুষিত করতে । এমনকি সাম্প্রতিক অতীতে করোনা অতিমারির সময়কালে চোখে পড়েছে গঙ্গার অববাহিকা বয়ে ভেসে আসা শবদেহের সারি । এমন ভয়ংকর বিষয় নিয়েও টুঁ শব্দটিও শোনা যায়নি বাজেট ভাষণে । জলাভূমি সংরক্ষণের বিষয়টিও কোনপ্রকার মান্যতা পায়নি এই বাজেটে ।
হিমালয় সংরক্ষণ
দেশের প্রায় প্রত্যেকটি প্রধান নদীরই উৎপত্তিস্থল বা উৎস হল হিমালয় । সেই হিমালয়কে রক্ষা করা কিংবা হিমালয় অঞ্চলের দূষণরোধেও কোন দিশা দেখায়নি এই বাজেট । প্রয়াত পরিবেশবিদ সুন্দরলাল বহুগুণার আলোড়ন তোলা “চিপকো” আন্দোলনের আঁতুড়ঘরেই চলছে গাছ কাটার কর্মকান্ড । উন্নয়নের নামে পাহাড় কেটে, গাছ কেটে, বড়ো বড়ো রাস্তা নির্মিত হচ্ছে এবং এর অনিবার্য ফলশ্রুতিতে পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে নামছে ধস ।
মাত্রাছাড়া বায়ুদূষণ
সাম্প্রতিক অতীতে মাত্রাছাড়া বায়ুদূষণের ফলে দেশের রাজধানীর কি হাল হয়েছিল আমরা সকলেই জানি । তারপরেও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের মত একটা অত্যন্ত জরুরি বিষয় নিয়েও কোন হেলদোল নেই কেন্দ্রীয় সরকারের ! তাঁরা যে বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন তার কোন নিদর্শন পাওয়া গেল না বাজেট ভাষণে ।
কৃষিজমি সংরক্ষণ
ইঁটভাটাগুলির দৌরাত্ম্যের ফলে রাজ্যে রাজ্যে কৃষিজমির উপর আক্রমণ অব্যাহত । এই বিষয়ে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন অথচ বিকল্প হিসেবে ফ্লাই অ্যাশ থেকে ইঁট নির্মাণ এবং ব্যবহারের প্রক্রিয়াকে উৎসাহ দেবার জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি বাজেট প্রণেতারা ।
বিভিন্ন কলকারখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও এবারের বাজেট বিস্ময়করভাবে নিশ্চুপ । কারখানার দূষণের প্রধান এবং প্রথম শিকার হলেন সেই কারখানার শ্রমিকরা । একটু আগেই যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে তার মূল চালিকাশক্তি হলেন সাফাইকর্মীরা । সেই সাফাইকর্মীদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়েও কোন কথা উচ্চারিত হয়নি এই বাজেটে ।
অন্যান্য বারের মতই এবারের বাজেটেও তাই ব্রাত্যই থেকে গেল পরিবেশ ভাবনা।
—————————————————————————————————————————————————————–
শহরের নীলকণ্ঠ – ব্রাত্য যে জন
ছোটবেলায় একটি নাটক পড়েছিলাম । তার মূল প্রতিপাদ্য শহরের ভিতরে ম্যানহোল খুলে একটি তরুণ ছেলে ড্রেন পরিষ্কার করতে নেমেছে এবং তার সঙ্গী ওপরে প্রতীক্ষারত । বেশ কিছু সময়ের পরও তরুণ সাফাইকর্মীটি যখন ওপরে উঠে আসছে না, তাই দেখে উপরের ছেলেটি চিৎকার করে পথচারী মানুষদের কাছে সাহায্য চাইল তার বন্ধুটিকে তোলার জন্য । অনেকে থমকে দাঁড়ালো, অসহায় ছেলেটিকে কিছু জ্ঞান দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল । কয়েক ঘন্টা পর দমকল এল এবং ড্রেনের ভিতর থেকে তরুণ সাফাইকর্মীটির নীল হয়ে যাওয়া দেহটি উপরে তুলে আনল । হাইড্রেনের মধ্যেকার জমা বিষাক্ত গ্যাসে তার মৃত্যু হয়েছে । শিবঠাকুর বিষ পান করে অমৃত পেয়েছিলেন বেঁচে থাকার জন্য । শহরের নীলকন্ঠের জন্য কোন অমৃত মজুত নেই । মৃত্যুই তার অনিবার্য সত্য । এই ঘটনাটি নাটকের উপাদান হলেও বাস্তবে এই ধরনের ঘটনা প্রায়শঃই খবরের কাগজের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি ।
সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমবঙ্গের বুকে পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সমস্ত রাজনৈতিক দলই ইস্তাহার প্রকাশ করেছে, যে ইস্তাহারে বিস্তৃতভাবে লেখা শহরকে সুন্দর করার পরিকল্পনা । রাজ্য সরকার “গ্রীন সিটি” প্রজেক্ট চালু করেছে শহরকে পরিবেশ বান্ধব বা পরিবেশ মিত্র করার জন্য । শহরকে পরিষ্কার রাখার অন্যতম শর্ত জঞ্জাল অপসারণ, তার সুষ্ঠ বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা ও তৎসহ নিকাশি ব্যবস্থার পরিকাঠামোগত উন্নতি বিধান । কিন্তু এই কাজটি করার প্রধান কুশীলব হলেন সাফাইকর্মীরা । সমস্ত শহরে সাফাই কর্মীরা মূলতঃ আসেন প্রান্তিক ঘর থেকে, যেখানে দারিদ্র্যই তাদের জীবনকে আবিষ্ট করে রেখেছে । আমরা যখন ভোরবেলায় বিছানায় শুয়ে থাকি সেই সময়ে সাফাইকর্মীরা রাস্তায় বেরিয়ে জঞ্জাল অপসারণ করেন । কারোরই হাতে নেই কোন গ্লাভস্ বা মুখে কোন আচ্ছাদন । যাঁরা নিকাশি ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত তাঁরা খালি পায়ে ড্রেনের পাঁকে নেমে সেখান থেকে ময়লা তুলে নিকাশি ব্যবস্থাকে সচল রাখার চেষ্টা করেন । শহরের আবর্জনার দুর্গন্ধ তাঁরা টেনে নেন বুকের পাঁজরে কারণ এই কাজটি না করলে পেটের ভাত জুটবে না । এই সমস্ত সাফাইকর্মীর একটা বৃহৎ অংশ অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ করে থাকেন এবং যৎসামান্য অর্থের বিনিময়ে তাঁদের এই কাজ করতে হয় । এঁরাই আমাদের সমাজের নীলকণ্ঠ ।
সমস্ত রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারগুলি পর্যালোচনা করলে যাবে সাফাইকর্মীদের পেশাগত দুরবস্থা দূর করতে বিশেষ কোন কথাই উচ্চারিত হয়নি কারণ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিরা যাঁরা ইস্তাহার তৈরি করেন তাঁদের কাছে এই সাফাইকর্মীরা ব্রাত্যজন । ওঁদের কষ্ট, ওঁদের যন্ত্রণা রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিদের স্পর্শ করে না । করোনা কালে সবাই যখন আতঙ্কিত তখনও নীলকণ্ঠ সাফাইকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন শহর পরিষ্কার রাখার তবু তাঁরা থেকে গেছেন আমাদের ভাবনার অলক্ষ্যে । আসন্ন পৌরনির্বাচনে এই নীলকণ্ঠদের নিয়ে কিছু কথা কি আমরা বলতে পারি না ? ভাবতে পারি না ? রবীন্দ্রনাথের কথায় এরা চিরকালই সভ্যতার পিলসুজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । শহরের সৌন্দর্য্য রক্ষার দায়িত্বে থাকা মানুষরা থেকে যান অবাঞ্ছিত এক জীবনের আবর্তে । শহরের অগ্রগতির অংশ হতে এঁরা কখনোই পারেন না । তাই চন্দননগরের লালদীঘির ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সৌন্দর্যায়ন হয় কিন্তু সাফাইকর্মীদের বাসস্থান থেকে যায় এক অত্যন্ত অবহেলিত পরিকাঠামোর মধ্যেই । কেবলমাত্র চন্দননগর নয়, যে কোন পৌর এলাকার সাফাইকর্মীদের বাসস্থানগুলিকে উন্নত করার কোন উদ্যোগ কখনোই চোখে পড়ে না । তাই নাগরিক সমাজকেই উদ্যোগ নিয়ে তুলে ধরতে হবে এঁদের দুর্ভাগ্যের কথা ।
গনতান্ত্রিক অধিকার বনাম জীবনের মূল্য
পশ্চিমবঙ্গে কিছুদিন আগে বিধানসভা এবং কলকাতা পৌর নির্বাচন হয়ে গেছে। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পৌরসভাতে দীর্ঘকাল যাবত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সাম্প্রতিককালে বিধাননগর, চন্দননগর, আসানসোল, শিলিগুড়ির পৌর নির্বাচন রাজ্য নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছেন রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে।
একথা ঠিক, গণতন্ত্রের মূল কথা – For the people, by the people, of the people. কিন্তু গণতন্ত্রের কুশীলব মানুষ আজ আক্রান্ত। সাম্প্রতিককালে করোনা মহামারীর জন্য প্রতি মূহুর্তে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মৃত্যু মিছিল বর্ধিত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা মহামারীর তৃতীয় বার আক্রমণের ব্যাপারে বারবার সতর্ক করেছিল। কিন্তু সেই সমস্ত সতর্কতাকে পেছনে ফেলে মানুষের উদ্দাম, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার কেউই রাজধর্ম পালনের উদ্দেশ্যে বা মানুষকে সুস্থ রাখার জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।
মাস্কহীন রাস্ট্রনায়কদের ঘিরে মানুষের ভিড়ের ছবি প্রত্যেকেই কাগজে, টিভিতে দেখেছেন। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজও মেলা বা উৎসবের ক্ষেত্রে বাধানিষেধ আরোপ করবার জন্যে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। নির্বাচনে জেতার পরে মানুষের মিছিল নিয়ন্ত্রণ করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। করোনা মহামারীর বাড়বাড়ন্ত যখন কিছুটা নিয়ন্ত্রিত ছিল সেই সময়ে রাজ্য সরকার বা রাজ্য নির্বাচন কমিশন বকেয়া পৌর নির্বাচনগুলি করার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেননি, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে অগ্রাহ্য করে রাজ্য সরকার বিভিন্ন উৎসবকে ছাড়পত্র দিয়েছেন যা প্রকৃতপক্ষে করোনার তৃতীয় ঢেউকে একপ্রকার আমন্ত্রণ করা। আমরা প্রত্যেকদিন খবরের কাগজের পাতায় করোনা আক্রান্তদের বর্ধিত সূচক দেখতে পাচ্ছি।
এই অবস্থায় আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন, আদৌ কি পৌর নির্বাচন করা সম্ভব? এই প্রসঙ্গে বার্গম্যানের একটি সিনেমার কথা মনে পড়ল – যেখানে নায়ক মৃত্যুর সঙ্গে বসে দাবা খেলছে। পঃ বঃ র বর্তমান নির্বাচনে বার্গম্যানের ওই দৃশ্যই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। মানুষই যদি বাঁচতে না পারে, তাহলে কাদের জন্য এই নির্বাচন?
কোনও দলের ইস্তাহারে সবুজ ফেরানোর প্রতিশ্রুতি নেই
কাল রবিবার কলকাতায় পুরভোট। অথচ এই ভোটের আগে কোনও দলের ইস্তাহারে কলকাতার বাতাসে দূষণ কমানো বা সবুজ ফেরানোর অঙ্গীকার নেই! তার প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের একটি পরিবেশ কর্মীদের সংস্থা ‘সবুজ মঞ্চ’ শহরের মানুষকে সচেতন করার কাজে রাস্তায় নেমেছে। এই সংস্থা ইতিমধ্যে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করেছিল যেন প্রত্যকেটি দলের প্রার্থী প্রচার চালানোর সময় এবং নির্বাচন চলাকালীন শহরের সবুজ নষ্ট না করেন। সংস্থাটির অভিযোগ, নির্বাচনের আগে প্রকাশিত কোনও রাজনৈতিক দলের (তৃণমূল, কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এবং বিজেপি) ইস্তাহারে শহরের পরিবেশ দূষণের সমাধানের কোনও কথা লেখা নেই। তাদের দাবি, এমনকী, শহরে শব্দ দূষণ,বায়ুদূষণ নিয়েও কোনও প্রতিশ্রুতির কথা লেখা নেই। পরিবেশবিদেরা বিস্মিত রাজনৈতিক দলগুলির ইস্তাহার দেখে। তাঁদের বক্তব্য, অদ্ভূত ব্যাপার যে, কোনও রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারে বায়ুদূষণ কমানো এবং কলকাতায় সবুজ ফেরানো নিয়ে কোনও প্রতিশ্রুতি নেই। রাজ্যের শাসক দল একদিকে বলছে বায়ুদূষণ কমাতে বৈদ্যুতিন গাড়ি বাড়ানোর কথা। অন্যদিকে তাদের ইস্তাহারে রয়েছে শহরে ৫০০টি বাস স্টপেজে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র বসানোর কথা! যাতে বায়ুদূষণ আরও বেড়ে যাবে! সবুজ মঞ্চের তরফে বলা হয়, রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে আবদেনের একটা ফল পাওয়া গিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের তরফে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নির্বাচনের পর যেন প্লাস্টিকের সমস্ত বর্জ্য তুলে নেওয়া হয়।
কয়েক সপ্তাহ আগে হওয়া পুরসভার শেষ বোর্ড মিটিংয়ে কিন্তু মেয়র ফিরহাদ হাকিম জানিয়েছিলেন, ক্ষমতায় আবার এলে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংস্থাদের সঙ্গে বৈঠক করে কলকাতায় আবার শুরু হবে সবুজের অভিযান। কিন্তু তাদের প্রকাশিত ইস্তাহারে সেই সম্পর্কে একটা বাক্যও নেই বলে জানিয়েছে সবুজ মঞ্চ। রাজনোইতিক দলগুলির কাছে তাদের দাবি অনেক। যার মধ্যে রয়েছে বায়ুদূষণ কমানো, পুরনো গাড়ি বাতিল করা, সৌরশক্তির সহায়তায় জল উৎপন্ন করা, শহরে গাছ কাটা বন্ধ করা, হাই-রাইজ নির্মাণের সময় বর্জ্য নির্দিষ্টস্থানে রাখা আর খোলা জায়গায় বর্জ্য না পোড়ানো। এই দাবি লিখিতভাবে পেশও করা হয়েছে সব দলগুলোর কাছে। কিন্তু শুনবে কে?
পরিবেশ সম্মেলন না ব্যবসা কেন্দ্র
গ্লাসগোর পরিবেশ সম্মেলন মূল ভবনে অদূরে ব্রিটিশ কিছু কোম্পানি অপ্রচলিত জ্বালানি চালিত নতুন কিছু প্রযুক্তি, পণ্য প্রদর্শন করছিল।
প্রদর্শনীতে দোতলা যাত্রী বাস রাখা হয়েছিল, যা ব্যাটারিতে চলে। ট্রাক্টর এবং রাস্তা খোঁড়ার ডিগার প্রদর্শিত হচ্ছিল, যা ডিজেলের বদলে চলবে হাইড্রোজেনে। রোল রয়েসের উদ্ভাবিত এক আসনের বিমান দেখানো হচ্ছে যা ব্যাটারিতে চলে।
নতুন এসব দুষণমুক্ত প্রযুক্তির যে আকাশছোঁয়া দাম তা গরীব দেশগুলোর ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ কমানোর খাতে দেওয়া তহবিলের বিপরীতে এমন সব প্রযুক্তি কেনার পরোক্ষ চাপ দরিদ্র দেশগুলোর ওপর কেন? সে ভয় অমূলক নয় কারণ বৈদেশিক সাহায্যের সাথে বিভিন্ন শর্তের তালিকা পাওয়ার অভিজ্ঞতা এসব দেশের রয়েছে। সম্মেলনে তাদের বক্তব্যে দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো জোর দিয়ে বলেছে যে তারা কার্বন নিরপেক্ষ প্রযুক্তি চায়, কিন্তু তা হতে হবে সহনীয় দামে এবং উন্নত দেশগুলো এই প্রযুক্তি নিয়ে ব্যবসা করতে পারবে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের ভূমিকা বাড়লে সস্তায় প্রযুক্তি পাওয়ার আশা পূরণ হবে কি না তা নিয়ে কিন্তু আশংকা রয়েছে। উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষ থেকে জোর দাবি তোলা হয়েছিল যাতে কমপক্ষে তহবিলের ৫০ শতাংশ এমন সব প্রকল্পে দিতে হবে, যেগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রতিক্রিয়া থেকে মানুষজনকে বাঁচাবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে তাদের সাহায্য করবে। উন্নত দেশগুলো পরিবেশ উন্নয়নে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ চেয়েছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে বেসরকারি খাতের আগ্রহ থাকতে পারে, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে বিপন্ন মানুষের সাহায্য করায় তাদের আগ্রহ থাকবে কি না সেই প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, বেসরকারি সংস্থা মুনাফা ছাড়া কিছুই করবে না।
সেই মুনাফা আসবে কার্বন নিরপেক্ষ প্রযুক্তি বিক্রি করে। বাস্তচ্যুত পরিবারের জন্য স্কুল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করে মুনাফা আসবে না।
জলবায়ু অর্থায়নে বেসরকারি খাতের ভূমিকার আওতা নিয়ে স্বচ্ছ চিত্র তুলে ধরার দাবি তুলেছে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো। সেই দাবি কিন্তু মানেনি উন্নত দেশগুলি।
সবুজ বাজির হারিকিরি
গত ২৬ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণের পক্ষ থেকে আসন্ন কালীপুজো, দীপাবলী, ছট সহ অন্যান্য অনুষ্ঠান ও উৎসব উপলক্ষে বাজির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক একটি নির্দেশনামা প্রকাশিত হয়েছে । এই নির্দেশনামায় ঘোষিত হয়েছে যে এই বিশেষ দিনগুলিতে কেবলমাত্র ‘সবুজ বাজি’-ই ফাটানো যাবে এবং কোন নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে এই বাজি ফাটানোর কাজটি করা যাবে তাও জানানো হয়েছে । এই নির্দেশের কথা শুনে মানুষ সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্ত । কেউই বুঝে উঠতে পারছেন না “সবুজ বাজি” বলতে ঠিক কোন বা কোন কোন বাজির কথা বলা হয়েছে । একইভাবে বিভ্রান্তির শিকার বাজি বিক্রেতারাও । আমাদেরও জানা নেই তথাকথিত এই ‘সবুজ বাজি’-র কোন নির্দিষ্ট তালিকা প্রশাসনিক কোন দপ্তর থেকে প্রকাশিত হয়েছে কি না । আমরা এও জানিনা স্থানীয় প্রশাসন কিংবা পুলিশ আধিকারিকরাও এই বিষয়ে ঠিক কতখানি ওয়াকিবহাল ! আমাদের আশঙ্কা, রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা বেআইনি বাজি কারখানাগুলিতে তৈরি নিষিদ্ধ বাজির আনাগোনা এবং ব্যবহার, এর ফলে, উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাবে । সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যেতে পারে যে নুঙ্গি, বজবজ, চম্পাহাটি, হারাল, সোনারপুর, বালি, বেলুর, চণ্ডীতলা, বেগমপুর, নৈহাটি, নীলগঞ্জ, বারাসত প্রভৃতি অঞ্চলে বেশ কিছু এই ধরণের বেআইনি বাজি তৈরির কারখানা রয়েছে। বাজি নিয়ন্ত্রণে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে একসময়ে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল । কোলকাতা হাইকোর্টের রায়ে বলীয়ান হয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণে দৃষ্টান্তমূলক কাজ করেন । পশ্চিমবঙ্গের দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে পরবর্তীসময়ে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়েই বাজি নিয়ন্ত্রণের কাজ চলতে থাকে। এই বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট অথবা হাইকোর্টের তাৎপর্যপূর্ণ। রায়গুলি ঘোষিত হয়েছিল করোনা আক্রমণের বহু আগে। বর্তমানের এই করোনা আবহে দূষণ সৃষ্টিকারী সকলপ্রকার শব্দবাজি ও আতশবাজির কঠোরতর নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক বলে মনে করছেন পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। যেখানে গতবছর সাধারণ মানুষ এবং প্রশাসনের সদর্থক ভূমিকা বেশ কিছুটা আশা জাগিয়ে ছিল, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সাম্প্রতিক ঘোষণা মানুষের মনে নানাবিধ আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে দুর্ভাগ্য এবং বিস্ময়ের বিষয় হল দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এই নির্দেশনামায় উল্লেখিত হয়েছে “cracker” শব্দটি যার অর্থ হল শব্দবাজি। হাইকোর্টের আদেশ অনুসারে যে শব্দবাজি এতদিন যাবৎ প্রায় নিষিদ্ধ ছিল, আমাদের আশঙ্কা, এই নতুন নির্দেশের ফলে সেই শব্দবাজিকেই ঘুরপথে একধরনের ছাড়পত্র দেওয়া হয়ে গেলো না তো ! আমরা এও মনে করি যে এই নির্দেশনামা সুপ্রিমকোর্ট ঘোষিত রায়ের অবমাননার নামান্তর। মূল প্রশ্ন হল দূষণমুক্ত পরিবেশ এবং জনগণের জন্য সুস্বাস্থ্য । সেই দিক থেকে বিচার করলে এখনও খুব দেরি হয়ে যায়নি। আমরা আশা করছি যে জরুরি ভিত্তিতে সমগ্র পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন । আমরা মনে করি, আর কালক্ষেপ না করে অবিলম্বে সবরকমের দূষণসৃষ্টিকারী শব্দবাজি ও আতশবাজিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ জারি করা হোক ।
শেষের ঠিকানা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আরো প্রায় ৭৬ বছর কেটে গেছে। নয়া উদারনীতির মোড়কে ফিরেছে সাম্রাজ্যবাদ। বড় আশ্চার্য এই ‘সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দটি। সাম্রাজ্যবাদীদের সাম্রাজ্যের সীমানা আসলে ব্রম্ভাণ্ডের একটি মাত্র গ্রহ- পৃথিবী। সাম্রাজ্যের সীমানা প্রসঙ্গে একটা ছবির কথা স্মরণে আসে। ১৯৯০ সালে ভয়জার-১ উপগ্রহের ৪০ লক্ষ মাইল দূর থেকে তোলা বিন্দুবৎ আমাদের পৃথিবীর ছবি। বিজ্ঞানী কার্ল সাগান সে ছবি সম্পর্কে বলেছিলেন “দ্যাটস আস। আ পেল ব্লু ডট”। ঐ বিন্দুই ৮০০ কোটি মানুষের ক্রিড়াভূমি। রাষ্ট্রপরিচালক-ধনকুবেরদের লম্ফঝম্পের জায়গা। কিন্তু ভাবুন, ঐ বিন্দুবৎ সাম্রাজ্যই যদি হয়ে পড়ে ব্রম্ভাণ্ডের আরো হাজার একটা গ্রহ উপগ্রহের মতো মানুষের অ-বাসযোগ্য! একলহমায় সাম্রাজ্যবাদের মতো কর্কশ, অশ্লীল, অমানবিক শব্দটি চুরমার হয়ে পড়বে।
নেহাৎ কল্পকথা নয়। আন্তর্জাতিক জলবায়ু বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘গ্লোবাল চেঞ্জ বায়োলজি’তে প্রকাশিত রিপোর্টে এমনই সতর্কবার্তা দিয়েছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের বিজ্ঞানীরা। রিপোর্টের পোশাকি নাম – ‘ইউনাইটেড নেশন্স অ্যাসেসমেন্ট অফ ন্যাশানালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশান’। রিপোর্ট অনুসারে, রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশনে বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমণের পরিমান কমানোর যে টার্গেট নিয়েছে, তা সবটুকু পুরণ করতে পারলেও আগামী ৭৯ বছরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা হবে অর্থনৈতিকভাবে শিল্পনির্ভর রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে ওঠার পূর্বের পৃথিবীর চেয়েও অন্তত ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। ফলে অকল্পনীয় ভাবে ঘনঘন ও ভয়ঙ্কর দাবানল হবে পৃথিবীজুড়ে। সেই সাথে বাড়বে ঘুর্ণিঝড়, খরা, বন্যা, তাপপ্রবাহ ও শৈত্যপ্রবাহ। সবমিলিয়ে ২১০০ র মধ্যেই নীলগ্রহ অ-বাসযোগ্য হয়ে উঠবে মানুষের। এবং আগামী ৪০০ বছরে মানবসভ্যতার কাছে নীলগ্রহ হয়ে উঠবে ভিনগ্রহ।
রাষ্ট্রপরিচালকরা, সাম্রাজ্যের প্রভুরা, ধনকুবেররা ঠিক করুন সাম্রাজ্য ভোগের মেয়াদ আগামী ৭৯ বছরের মধ্যেই ফুরিয়ে ফেলবেন কিনা? ‘যদিও ক্ষতি নেই তাতে। দুরাত্মা আর অকর্মণ্য সন্তানের বিলোপে দুঃখ নেই বসুন্ধরার। একটু জিরিয়ে নিয়ে অলসগমনা বসুন্ধরা দশ-বিশ লক্ষ বছরে আবার হয়তো সুপ্রজাবতী হবার জন্যে সসত্ত্বা হবেন।’
ঋণ: রাজশেখর বসু
‘তালিবান’-দের সম্বিত ফিরুক
আফগানিস্থান জ্বলছে, মানুষ কাতরাচ্ছে পথে ঘাটে। আমেরিকার হাতে রাজনৈতিক পরাধীনতার থেকে বেরনোর রাস্তা হিসাবে সায়ত্বশাসনের যে রাস্তা আত্মঘাতী প্রবল যুদ্ধের হাত ধরে সেখানে আসছে, তা সব মিলিয়ে গভীর সামাজিক পরাধীনতার এবং মধ্যযুগীয় সামন্ত শাসনের ইঙ্গিতবহ বলে বহু মানুষ মনে করছেন। দলে দলে মানুষের দেশ ছাড়ার, হতাহত হবার দৃশ্য সাড়া পৃথিবীর সচেতন বিবেক ও ভাবনাকে নাড়া দিচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক প্রলয়, জীবনের অসুরক্ষা সব মানুষকেই ভাবায়। আফগানিস্থানের বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানকর্মীরা এই মুহূর্তে অসহায়ের মতো খাঁচায় আটকানো। বিজ্ঞানী না থাকলে বিজ্ঞান ও থাকে না। কাজেই আফগানবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানকর্মীদের জীবন বাঁচানোই যেখানে সমস্যা সেই পরিবেশে তারা বিজ্ঞানের কাজ কতটা করতে পারবেন তা অবশ্যই প্রশ্ন। কিন্তু তার থেকেও বড় প্রশ্ন বিজ্ঞানীরা জীবন বাঁচাবেন কি ভাবে? নতুন শাসকদের কাছে ‘বিজ্ঞান’ আদৌ সহায়ক বস্তু বলে তাদের অতিপরিচিত আদিম ভাবনায় উঠে আসবে কিনা সে প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে।
যুগে যুগে এমনটা হয়েছে। না, অন্ধকারের মাদকতায় আচ্ছন্ন স্বৈরশাসকদের সামন্ত চিন্তায় বিজ্ঞানের কোন জায়গা থাকে না। আইনস্টাইনকেও জার্মানি ছাড়তে হয়েছিল- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই- ১৯৩৩ সালে। ১৯২২ সালে নোবেল পুরষ্কারে সম্মানিত বিজ্ঞানী হিটলারের একনায়কতন্ত্রী মনোভাব ও মানববিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করার শাস্তি হিসাবে শুনেছিলেন যে তার বিজ্ঞান হচ্ছে ‘ইহুদি বিজ্ঞান’। আইনস্টাইনের ছবি টাঙ্গিয়ে ল্যাম্পপোস্টে নাৎসীরা লিখেছিল ‘এখনও হত্যা করা হয়নি যাকে’। নেহাত জীবন রক্ষার জন্য, বিজ্ঞানের সুর সাধনা চালিয়ে যাবার জন্য আইনস্টাইন ’৩৩ সালে প্রায় নিঃশব্দে জার্মানি ছাড়েন। বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড হয়ে পৌঁছান আমেরিকায়। যুদ্ধ, অস্থিরতা তার মতো সৃষ্টিশীল বিজ্ঞানীর কাজের কতটা ক্ষতি করেছিল হিসেবের স্পর্ধা আমাদের নেই। কিন্তু তার আত্মিক যন্ত্রণা- শরণার্থীর বেদনা আমাদের নতুন করে মনে করাচ্ছে আফগান সঙ্কটের চলমান ছবিগুলো।
তালিবানরা নতুন নয়। অসহিষ্ণু, একদেশদর্শী গোষ্ঠীচিন্তায় বুঁদ হয়ে থাকা শাসকেরা পৃথিবীতে যখনই যে দেশেই শাসন করেন- তারাই একম্ম করে থাকেন। যুক্তি, তথ্য আর তর্ক করার বিজ্ঞানের মূলউপাদানগুলো এদের কাছে অসহনীয় ঠেকে। আঁধার নামিয়ে এনে সামাজিক নিষ্পেষণ, ভীতি আর সর্বব্যাপী আত্মসমর্পণের বাতাবরণ স্বৈরশাসকেরা তৈরি করেন। বিজ্ঞানের আলো তাদের কাছে বিভীষিকার মতো ঠেকে। তাই চিন্তাশীল আর বিজ্ঞানীদের উপর রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবও এসে পড়ে খুব তাড়াতাড়ি। বিজ্ঞানের কোন বিশ্বাসের ভিত্তি নেই। বিশ্বাসের আগল ভেঙ্গে নতুন চিন্তায় ডুব দেওয়া, অজানা তথ্যকে তুলে আনাই বিজ্ঞানের কাজ। আফগান তালিবানদের হাত থেকে মুক্তি পেতে বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানের কাজে যুক্ত মানুষদের হুড়োহুড়ি এই যুগভাবনাকেই আবার সামনে এনেছে। ঘাড়ের কাছে বন্দুকের নল থাকলে বিজ্ঞানের নিরীক্ষা আদৌ এগোয় না। স্বচ্ছ আকাশ, মুক্ত চিন্তা, প্রশ্ন করার অধিকারকে প্রশ্রয় দিয়েই যে কোন দেশের শাসকদের বিজ্ঞানকে এগোনোর পথ করে দিতে হয়। নচেৎ দেশও এগোয় না। বিজ্ঞানীরা তোতা পাখী হন না। আর আলমারীতে সাজানো বিজ্ঞানের শবদেহ নিয়ে দেশও ডোবে কালের গর্ভে। আশা করব পৃথিবীজোড়া তালিবানদের সম্বিত ফিরবে। যদিও তা কষ্ট কল্পনা।
বিজ্ঞান ভাবনা কি স্বাধীন হয়েছে?
ভারতবর্ষ এমন এক দেশ যেখানে বৈচিত্র্যের অভাব নেই। বৈচিত্র্য সংস্কারে, বৈচিত্র্য সংস্কৃতিতে, বৈচিত্র্য ভাষায়। এখনও হাজারো রকমারি কুসংস্কার। এদেশের কোনো অঞ্চলের মানুষ এখনও বিশ্বাস করেন, মৃন্ময় গনেশ দুগ্ধ সেবন করেন, কোনো অঞ্চলের মানুষ এখনও মনে করেন, সতীদাহ প্রথা জিইয়ে রাখাটা পুণ্যের কাজ, আবার অনেক জায়গার মানুষ মনে করেন – বিষধর সাপে কামড়ালে ঝাড়ফুঁকেই ভিক্টিম বেঁচে ওঠে, নইলে তাকে বৈতরণীতে ভাসিয়ে দিতে হয়।
আমরা সবাই জানি, ইউরোপীয় সভ্যতার হাত ধরেই ভারতের আধুনিকতার আলো পাওয়া। আলো-পাওয়া মানে এনলাইটেনমেন্ট, বিজ্ঞান ও যুক্তিকে সামনে রেখে বেঁচে থাকা ও বাঁচিয়ে রাখা। এখন যাকে আমরা আধুনিক বিজ্ঞান বলি – সেই চর্চাও ইউরোপীয়দের হাত ধরেই এসেছিল এদেশে। আমাদের দেশেরও নিজস্ব চর্চার জায়গা ছিল বটে কিন্তু তা “আধুনিক” ছিল না। তারাশঙ্করের আরোগ্য নিকেতন মনে করুন। সে-গল্প সনাতন কবিরাজি প্রথা বনাম আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বোঝাপড়ার। ভারতে যে সমস্ত প্রাচীন চর্চা ছিল, সেগুলোর প্রায় কোনোটাই আধুনিক বিজ্ঞানে স্থান পায় নি। এমনকি ব্যাকরণ চর্চার ক্ষেত্রেও যে ঐতিহ্যের দেশ এই ভারত, সে ঐতিহ্য আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের থেকে আলাদা। অনেক বিষয়ে ভেতরে ভেতরে মিল থাকা সত্ত্বেও। অর্থাৎ, ভারতীয় চর্চার চরিত্র আধুনিক চর্চার চরিত্রের থেকে আলাদা ছিল। দৃষ্টান্ত দিলেই জিনিসটা বোঝা সহজ হবে। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে অনুমান প্রমাণ নয়, কিন্তু ভারতীয় ন্যায়শাস্ত্রে তো বটেই, আয়ুর্বেদশাস্ত্রেও অনুমানের গুরুত্ব ছিল সাংঘাতিক।
কিন্তু আজকের প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। যেভাবেই হোক, ভারতীয় চিন্তায় আধুনিক বিজ্ঞানের ছোঁয়া তো লেগেইছিল সেই উপনিবেশের আমলে। ভারতে অনেক পণ্ডিত মানুষ আধুনিক বিজ্ঞানচর্চায় অংশগ্রহণও করেছেন। কিন্তু আজ ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতার ৭৬ বছরের মাথায় এসে আমাদের মনে সংশয় জাগে, আমরা কি সত্যিই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এমন কোনো বিশেষ অবদান রাখতে পেরেছি; ভারতীয় সমাজে সরাসরি যার ফলশ্রুতি ঘটতে পারে!
বিজ্ঞানের সরাসরি চর্চা করা আর বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হয়ে ওঠার মধ্যে কিন্তু ফারাক আছে। যেমন ফারাক আছে গণিত জানা আর গাণিতিক মন তৈরি করার মধ্যে। একজন শিল্পী, চিত্র শিল্পীর কথাই ধরা যাক। তিনি যখন কোনো ছবি আঁকেন, তখন তাঁর প্রতিটা আখরে-টানে গণিতের সূত্র নিহিত থাকে, কিন্তু তাই বলে তাঁকে গণিতের সমীকরণ জানতে হয় না। আমাদের বিজ্ঞানভাষ যখন ত্রৈমাসিক বেরোতো, তখনও যেমন, বিজ্ঞানের প্রসার সকল মানুষের মধ্যে হোক – এই চেতনা আমাদের কর্মীদের মধ্যে কাজ করত, এখনও দৈনিক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশের শুরু থেকেই – তেমন চেতনাই জাগরুক রয়েছে।
ভারতবর্ষে বিজ্ঞানের অগ্রগতি বলতে যা বোঝায় – তা মূলত তিনভাবে কাজ করে এসেছে শুরু থেকে। এক, জ্ঞানতাত্ত্বিক বিজ্ঞানচর্চা, দুই হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে উন্নত করা আর তিন, কুসংস্কার বা কুপ্রথা নিবারণে সমাজকে সচেতন করে তোলা। তৃতীয় কাজটাই ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা ঘটিয়েছে বললে অত্যুক্তি করা হয় না। রামমোহনের সতীদাহ, বিদ্যাসাগরের বাল্যবিবাহ রোধ, ইত্যাদি আইন প্রণয়ন – সেই কাজের কথাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়। অথচ, আজও সেই কাজ জ্ঞানচর্চার মহলে বা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে খুব একটা মর্যাদা পায় না। কেন?
জওহরলাল নেহরু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্র তৈরি বা নদীতে বাঁধ দেবার কথা যেভাবে উপলব্ধি করেছিলেন – সেভাবে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির ঘটেছে বলে ধরা হয়। নেহরুর উদ্যোগে বৈজ্ঞানিক গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রায় ৫০টি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় স্বাধীনতার পরেই। এই উদ্যোগকে আমরা গর্বের সঙ্গেই মনে রাখছি। কিংবা মনে রাখছি সত্যেন্দ্রনাথ বসু বা জগদীশচন্দ্র বসুর মতো মানুষের বৈজ্ঞানিক কাজের অবদানকে অথবা রামানুজনের মতো গাণিতিক প্রতিভাকেও। সেইসঙ্গে মনে রাখব, কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে সি সুভ্রমনিয়মের কথাও, যাঁর কৃতিত্বে, এক ধাক্কায় ১৯৬২ সালে, কৃষিজাত খাদ্য-উৎপাদন ৩৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানবোধ, যুক্তিনিষ্ঠতা কতটা গড়ে উঠল এই ৭৬ বছরে – সে-কথাও মনে হয় হিসেবের মধ্যে রাখা দরকার। না-হলে রামানুজনের মতো শ্রেষ্ঠ প্রতিভারও ম্লেচ্ছ খাবার না-খাওয়ার ফল হিসেবে বিজ্ঞানের এন্তেকাল ঘটবে – যা খুবএকটা সুখের নয় বলেই মনে হয়। কী বলেন?
বিজ্ঞানভাষ দৈনিক- এক দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা
বিজ্ঞানভাষ দৈনিক হিসেবে আসছে। মাধ্যম আন্তর্জালিক। মূল লক্ষ্য, বিজ্ঞানের খবর সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া। পৃথিবীর নানা প্রান্তের বিজ্ঞান-বিষয়ক খবর বাঙালি পাঠকের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা। বিজ্ঞান দৈনিক, কথাটা শুনলে চমকে উঠতে হয় বৈকি! তবে আমরা চমক সৃষ্টি করতে চাই না। কিছুটা খ্যাপামি আছে, বিশু পাগলই তো শুধু রক্ত করবীর খোঁজ রাখে। স্পর্ধা নিশ্চয়ই আছে। পৃথিবীর গতি, সে-পৃথিবীর সঙ্গে জীবজগতের সম্পর্ক, এ-সব নিয়ে প্রতিদিন সংবাদ পরিবেশন করা, কঠিন। কিন্তু পৃথিবীর গতির সঙ্গে মানুষের তাল মিলিয়ে চলার গোটা প্রক্রিয়াটাইতো দুঃসাহস। ‘বিজ্ঞানভাষ’ সেই দুঃসাহসের অংশীদার। তারই প্রেরণা থেকে শুরু হল দৈনিক বিজ্ঞানভাষ-এর পথ চলা।
ভাবনাটা পুরনোই। বাংলা ভাষার ছন্দ আর নান্দনিক অন্তরের সঙ্গে বিজ্ঞানের শক্তি, সৌন্দর্য আর স্পর্ধার সম্মিলন। স্বপ্ন দেখা- পাতা নড়া জল পড়ার মতো বিজ্ঞানের প্রতিটা শব্দ প্রতি অনুক্ষণে যেন পৌঁছে যায় বাংলা ভাষায় কথা বলা প্রত্যেকের কাছে। যেভাবে আমরা খেলার জগতের পান থেকে চুন খসার খবর নিয়ে মেতে উঠি, রাজনীতি বা বিনোদনের নেশায় ডুবে যাই, সেভাবে তো আমরা বিজ্ঞানের ধরা-অধরা জগতে পা ফেলতে চাই না। সে জগৎ আমাদের কাছে সুদূরের গ্রহ, ওটা যেন বিজ্ঞানী নামের অতিপ্রাকৃতিক, অধিভৌতিক অস্তিত্বের অধিকারীদের একমাত্র হকের জিনিস। আমা-জনতার আলোচনায় বিজ্ঞানের কল্পনা যেন বড় কঠিন, কর্কশ, দাঁতভাঙা। ‘অতসত বুঝিনা বাবু’ তেই তার পথচলা শেষ হয়। যদিওবা কেউ চেষ্টা করেন বিজ্ঞানের দুরূহ তত্ব বা তথ্যকে সোজা-সাপটা ভাবে পৌঁছে দিতে- তখন আবার ভ্রুকুটি ছুটে আসে সনাতন ধর্মচারীদের থেকে। ‘জোলো’ হয়ে যাচ্ছে বলে অপাংতেয় মনে হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। বিজ্ঞান যে পৃথিবীর সতত বয়ে চলা সহজ, সরল অস্তিত্বের চর্চা- তা মেনে নিতে মন চায়না কিছুতেই। সংস্কৃতি আর অভ্যাস আমাদের বড় বালাই। দাঁতফাটা শব্দে শোভিত হয়ে টাই পড়া সাহেবরা যতক্ষণ মাথায় মুগুর মেরে বিজ্ঞানের কথা আমাদের বলেছেন ততক্ষণ মনে হয় না ব্যাপারটা জমলো। স্কুলে বিজ্ঞান পড়ার ব্যাপারটা তো এখনও পুরোপুরি ভূতের বাড়ীর প্রবেশাধিকার গোছের করে রাখা আছে। ফাটাফাটি নম্বর পেয়ে খোলসা মাথা ঠিক করার মানদণ্ডে যারা উত্তীর্ণ হতে পারেন- তারাই শুধু সাহস করে বিজ্ঞান পড়েন। ‘তোর মাথা নেই, বিজ্ঞান টানতে পারবিনা’- শুনতে শুনতেই অনেক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওবাড়ীর দরজায় কড়া নাড়ার সাহস পাননা। এর পরের গপ্পোটা আরও পরিচিত। শুধু সোপান বেয়ে এগিয়ে চলা। কারো বা আছড়ে পড়া, মাথা ফাটা। ডিগ্রীর ঝনঝনানি আর অভিজাত্যের কার্পেটে পথ চলতে চলতে বিজ্ঞানের ঢেকুর তোলা চলতেই থাকে। হীরক রাজার সভার মতো অনেকটাই। রাজসভা-বিদ্যৎসভায় যখন আলোর রোশনাইতে ঝলকে ওঠে বিজ্ঞানের পরীকশায় পাওয়া নম্বর তখন সমাজ জুড়ে চলতে থাকে বুজরুকী, সংস্কার আর লীলা খেলার চর্চা। হবে নাই বা কেন? আমরা তো মানুষের জীবন ও বিজ্ঞানের অবিচ্ছিন্ন অস্তিত্বের কথা বলিইনি কখনও। বিজ্ঞান হয়ে আছে সমীহ আর সম্ভ্রমের বস্তু। বিজ্ঞান পড়ার অধিকারটাও ঠিক ওরকম পরিখা দিয়ে ঘেরা। মাথা যথেষ্ট ভালো না হলে সে নাকি বিজ্ঞান বুঝবে না। অতএব ও পথে তার যাতায়াতের ক্ষমতা নেই! ভালবাসা নয়, মেধার অদ্ভুত মাপকাঠিতে ভালো সাফল্য না আসলে বিজ্ঞান পড়া যাবে না। এটাই দস্তুর। উল্টোদিকে মেধার আগুনে জ্বলতে জ্বলতে যারা বিজ্ঞানের রথে চেপে বসতে পারে, নিজেদের সর্বোত্তম ও সফলতম মানুষ ভাবার গর্বে তাদের পা আর মাটিতে নামতেই চায় না। বিশ্বাস পথ আটকায় যুক্তির, তর্কের, নতুন ভাবনার।
দেশ বিরাট, বিচিত্র তার লোক-সংগঠন, ভাষা, আচার-বিচার। এমন এক লোকসমষ্টির মধ্যে বিজ্ঞানের চর্চা করতে হলে “কুলীন” অহংকারটাকে বিসর্জন দিতে হবে। বিজ্ঞানকে নিত্যদিনের সঙ্গী করতে হবে, লোকের সঙ্গে লোকের কথায়-বার্তায় বিজ্ঞানকে নিয়ে আসতে হবে, তাতে লোকেরও সমৃদ্ধি, বিজ্ঞানেরও। ময়ূরাক্ষী, দামোদর, অজয়, গঙ্গা, তিস্তা, তুঙ্গভদ্রা ঘেরা এ বঙ্গে একাজের একমাত্র বাহন হতে পারে বাংলা।
মজার ব্যাপার হল- বিজ্ঞান বিজ্ঞান খেলা গ্রামে হয়না, শহরেও না। অথচ টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতে বাংলার গাঁ-এর মাঠগুলোতেও এখন বছর জুড়ে ফুটবল সরিয়ে ক্রিকেট খেলা চলছে। দৃশ্যশ্রাব্য ও সমাজ মাধ্যমে ভাল করে ‘খাওয়াতে’ পারলে মানুষের ভাবনা ও ব্যবহারকে যে প্রভাবিত করা যায়- করোনা পরিস্থিতি সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল। যত ভয়, শঙ্কা, ভুল তথ্যের ঢেউ সামলে আমরা এখনও করোনাকে নিয়ে ঘর করছি এবং করোনাকে কেন্দ্র করে নানা খবরের চর্চা করছি তার অনেকটাই এই সূত্রগুলোতেই পাওয়া। আসলে ভয়ের খবর অসহায়ত্বের আবরণে ঢাকা পৃথিবীতে ছড়ায় বিদ্যুতের থেকেও তাড়াতাড়ি। অজানা, অচেনা, হানিকর বিষয়কে জানার জন্য আগ্রহের মাটি তৈরীই থাকে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে সেই আগ্রহের শিখাটাকে প্রজ্জ্বলিত রাখার, শুদ্ধ রাখার। দু’দণ্ড মানুষের পাশে বসে, তার কথা শুনে যদি পথ ঠিক করি, তাহলে পথ নিজেই এসে আমাদের সামনে হাজির হবে। বিজ্ঞান পড়ার আগ্রহ তৈরি করতে গেলে আগে দরকার বিজ্ঞান শোনা ও বিজ্ঞান বলা, বিজ্ঞান নিয়ে কথোপকথন। বিজ্ঞানভাষ যদি এটা করতে চায়। সে শুনতে চায়, এবং সেই শোনা থেকে পাওয়া পথ ধরে বিজ্ঞানের কথোপকথন চালিয়ে যেতে যায়। বিজ্ঞানের ভাষা, আমাদের মানতেই হবে, মুখের ভাষা থেকে আলাদা। কিন্তু, এটাও মানতে হিওবে যে, মুখের ভাষা থেকে রসদ না নিয়ে বিজ্ঞানের ভাষা তৈরি হয় না। বিজ্ঞানভাষ এই দূরত্বটা ঘুচিয়ে বিজ্ঞানের ভাষাকে এমনভাবে সমৃদ্ধ করে তুলতে চায়, যাতে তথাকথিত সাধারণ মানুষের কাছে তার আসা-যাওয়াটা হয়ে ওঠে সহজ আত্মীয়তার মতো। প্রতিটা মানুষ ভাবতে শুরু করবে, বিজ্ঞান আমারও। ভূতপূজো বন্ধ হয়ে বিজ্ঞানের কেন্দ্র হবে গ্রামে, শহরের বহুতলে, পাড়ায়, বস্তিতে।
সব স্পর্ধা, সব ঐতিহ্য, ইতিহাসের শিক্ষা বুকে নিয়ে বিজ্ঞানভাষ দৈনিক হচ্ছে। সঙ্গে আছে বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্য। বিজ্ঞানের বিশ্বে লোকসমাজের পদার্পণ ঘটবে, বিজ্ঞান নিজেকে লোকবিশ্বে উপস্থিত করবে, এই আশাই বিজ্ঞানভাষ দৈনিকের দুঃসাহস। সম্বলও বটে।
উপদেষ্টামণ্ডলী
পার্থপ্রতিম মজুমদার, সাত্যকি ভট্টাচার্য
সম্পাদক
অভিজিৎ চৌধুরী
সহ সম্পাদক
দীপেশ কুমার দাস
সম্পাদকমন্ডলী
পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়, বিষাণ বসু এবং স্বপন চক্রবর্তী
সম্পাদকীয় বিভাগ
সোমা দাস, সৌরভী দে এবং সহেলী চ্যাটার্জী
কারিগরি সম্পাদনা
উত্তম কুমার