বিজ্ঞানভাষ কেন?

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান পত্রিকা চাই কেন ? নতুন ক’রে, নয়া আঙ্গিকে ! বেশ কিছুদিন ধ’রেই এই প্রশ্নটা নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোড়িত হয়েছি, চর্চা করেছি। প্রশ্ন করেছি– এ পত্রিকার প্রয়োজন কী ? বিশ্ব বিজ্ঞানের প্রতিদিন পালটাতে থাকা চেহারাটা আর চমক দেওয়া সব কর্মকাণ্ডের বাংলা ভাষায় ধারাবিবরণী দিয়ে গা গরম করার জন্যই এটা প্রয়োজন ? নাকি ঐতিহ্যের মর্মরধ্বনির সাথে বর্তমানের বাস্তবতার মিল হতে গিয়ে ব্যথা পাওয়া বাঙালি বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানভাবনাক্লিষ্ট মানুষজনের অভিমান ও অতৃপ্তি প্রকাশ করার জায়গা দেওয়ার জন্য তা দরকার ? বাংলা ভাষার নৌকাটা নাকি বিজ্ঞানের প্রবল স্রোতে টাল সামলে বাইতে পারেনি। চরে আটকেছে বারবার। নৌকায় জমেছে শ্যাওলা, চরে জন্মেছে দূর্বাঘাস। নৌকার যাত্রীরা উঠে গেছেন চাকচিক্যমন্ডিত সপ্তডিঙ্গা মধুকরে – ইংরাজি ভাষায়। এ কি বাংলা ভাষার দুর্বলতা ? নাকি আমরা যারা বিজ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করি, বিজ্ঞানী ব’লে পরিচিতি পাই- তাদের সত্তার দৃঢ়তা এবং নিজের ভাষার উপর ভরসার অভাবে ?

এ বিতর্ক চলতেই থাকবে- তেমনি চলতে থাকবে নতুন উদ্যোগও। ‘বিজ্ঞানভাষ’-এর ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তাই যথার্থই আমাদের শুনতে হয়েছে- নতুন পত্রিকার কী প্রয়োজন ? এও শুনতে হয়েছে পুরনো উদ্যোগগুলিকেও আরও উজ্জ্বল করতে মনোযোগী হওয়াটা আরও ফলপ্রসূ হতে পারে। অনেক সমমনস্ক শুভানুধ্যায়ী দীর্ঘশ্বাসের মেদুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে উচ্চারণ করেছেন- অনেক তো এরকম চর্চা দেখলাম ! ঐ আরকি ? দেখা যাক কতদূর যায় ! “হোক-হোক–দেখা যাবে !”

আমরাও বলি হোক দেখা যাক । তারপরে এও বলি ‘হবেই’ । নতুন প্রয়াস সবসময় বিষয়টির গতিময়তার ইঙ্গিত দেয়। তাতে পুরনো, সনাতন প্রবাহ পুষ্টি পায়। একে অন্যের পরিপূরক, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। বাংলাভাষায় বিজ্ঞান চর্চার আখড়া যত বাড়বে, বিজ্ঞান পিপাসুর সংখ্যাও বাড়বে তত, আগ্রহ তৈরির সাথে সাথে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের দৃশ্যমানতার ক্ষেত্র হবে ক্রমশঃ বিস্তীর্ণ। এতে বাংলার লাভ, লাভ বিজ্ঞানের।

প্রকৃতি আর জীবন নিয়ে নানান অবিন্যস্ত স্বপ্ন, ভেসে বেড়ানো ভাবনাকে নিবিড় পর্য্যবেক্ষণের ছাঁচে ফেলে পথ চলেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানী সুর ভাঁজেন, স্বরলিপিও বানান। কিন্তু তা আরও বেশি সংখ্যার মানুষের কাছে তাদের বোঝার মতো ক’রে পৌঁছতে না পারলে সেই সুর সীমাবদ্ধ থাকে। আর মানুষজনও বিজ্ঞানকে ভাবে বিজ্ঞানীদের সম্পত্তি- প্রতিদিনের জীবনের বিষয় নয়। বিজ্ঞানীকুলও সাধারণ মানুষের ভাবনা যে বিযুক্ত হয়ে এক হর্ম্যগৃহে দিন কাটান- যেখানে আত্মশ্লাঘা ক্রমশঃ তালহারানো আত্মপ্রচারে মুখ গোঁজে। বিজ্ঞানী যে আবেগে আর পরিশ্রম দিয়ে সূত্রনির্মাণ এবং জীবনকে আরও সুন্দর করার সামগ্রী বানিয়েছিলে- সাধারণ মানুষ তাকে দূর থেকে শ্রদ্ধা করে, সমীহ করে বেশি- নিজের ব’লে মনে করতে চায় না । কারণ সে বুঝে উঠতে পারে না যে এটা তার কল্যাণের জন্যেই।

‘বিজ্ঞানভাষ’ বাংলাভাষায় ভাবতে শেখা, বাংলা ভাষায় কথা বলা চল্লিশ কোটি জনসংখ্যার কাছে পৌঁছতে চায়- বিজ্ঞান ভাবনা নিয়ে। বিজ্ঞান শিক্ষা, বিজ্ঞান মনস্কতা আর বিজ্ঞান অভিক্ষা- শব্দগুলি শুনতে এক হলেও- সরলরেখায় হাঁটে না। এর অন্যতম কারণ নিজের ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা না করা। ছাপানো পত্রিকার চেনা অবয়বের বাইরে অক্ষর নির্ভর বৈদ্যুতিন চরাচর আমাদের সামনে নতুন ক্ষেত্র খুলে দিয়েছে।

আমরা সেখানে থাকতে চাই – মুক্ত প্রমিথিউসের মতো। আপনারা নজর রাখবেন। লিভার ফাউন্ডেশন, পশ্চিমবঙ্গের এই উদ্যোগে রাজ্যসরকারের উচ্চশিক্ষা দপ্তর প্রেরণা ও উত্তাপ জুগিয়েছে।

সমস্ত বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বিজ্ঞান ভাবনার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ হয়ে উঠুক ‘বিজ্ঞানভাষ’- এই কামনা করি।

উপদেষ্টামণ্ডলী
পার্থপ্রতিম মজুমদার, সাত্যকি ভট্টাচার্য

প্রধান সম্পাদক
অভিজিৎ চৌধুরী

সহ সম্পাদক
দীপেশ কুমার দাস

সম্পাদকমন্ডলী
পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়, বিষাণ বসু এবং স্বপন চক্রবর্তী

সম্পাদকীয় বিভাগ
সোমা দাস, সৌরভী দে, সহেলী চ্যাটার্জী, অরিন্দম ব্যানার্জী এবং সুপর্ণা চট্টোপাধ্যায়

কারিগরি সম্পাদনা
অরিন্দম ব্যানার্জী

লিভার ফাউন্ডেশন, পশ্চিমবঙ্গ-এর একটি উদ্যোগ