অদৃশ্য রাঁধুনি অণুজীব

অদৃশ্য রাঁধুনি অণুজীব

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

খাদ্যের ইতিহাসে অণুজীব জড়িয়ে আছে বেশ কয়েক হাজার বছর ধরে। মানুষ অণুজীবকে ব্যবহার করছে খাবারকে সুস্বাদু, পুষ্টিকর এবং দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য। আজও দুধ থেকে দই,কিমচি, আঙুর থেকে মদ বা বিয়ার, বাঁধাকপি থেকে সাওয়ারক্রাউট সবই সম্ভব হয়েছে ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, যেখানে অণুজীবের ভূমিকাই প্রধান। এসব খাবারে প্রোবায়োটিক, ভিটামিন, ওমেগা ফ্যাটি অ্যাসিড ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসহ নানা স্বাস্থ্যকর উপাদান থাকে, যা আমাদের সুস্থ রাখে।
তবে গবেষকরা মনে করেন, খাদ্য উৎপাদনে অণুজীবের ব্যবহার এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। অণুজীবকে নতুনভাবে ব্যবহার করে অপচয় হওয়া খাদ্যকে নতুন রূপ দেওয়া, স্বাদ পরিবর্তন, এমনকি অখাদ্য বস্তু থেকে প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার বানানো সম্ভব। এজন্য দরকার আরও গবেষণা। দরকার ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়ার অণুজীবীয় গঠনকে বোঝা, নতুন স্বাদ তৈরির কৌশল উদ্ভাবন এবং ভোক্তাদের মধ্যে এসব খাবারের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করা।
কিভাবে অণুজীব আমাদের খাদ্যের স্বাদ ও পুষ্টি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে তার কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। কেফির নামক এক দুগ্ধজাত পানীয়তে একসঙ্গে কাজ করে প্রায় ৫০ প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া ও ইস্ট। সম্প্রতি গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন কিভাবে এই অণুজীবেরা নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা করে পরিবেশের পরিবর্তনের মধ্যেও টিকে থাকে এবং একই স্বাদ বজায় রাখে। ফলে কেফির কেবল এক পানীয় নয়, বরং এক জীবন্ত অণুজীব সমাজ।
আবার চকলেটের ক্ষেত্রেও লুকিয়ে আছে সেই অণুজীবের যাদু। কলোম্বিয়ার একদল বিজ্ঞানী বিশেষ কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক একত্র করে একটি নির্দিষ্ট মিশ্রণ তৈরি করেছেন। আশ্চর্যের বিষয়, নিম্নমানের কোকো বীজ থেকেও এই মিশ্রণ ব্যবহার করে উৎকৃষ্ট স্বাদের প্রিমিয়াম চকলেট তৈরি সম্ভব হয়েছে। পরীক্ষকরা স্বাদে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাননি। এতে কৃষকের আয় বাড়বে, আর বিশ্ববাজারে খুলবে নতুন সম্ভাবনা।
অন্যদিকে, ইন্দোনেশিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার অনকম হল বর্জ্য থেকে ভোজ্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ । সেক্ষেত্রে নিউরোস্পোরা ইন্টারমিডিয়া নামক এক বিশেষ ছত্রাক সয়া দুধের অবশিষ্টাংশকে পুষ্টিকর খাবারে রূপান্তর করে। শুধু তাই নয়, ফল ও সবজির বর্জ্য থেকেও এটি নতুন খাদ্য তৈরি করতে পারে। এটিকে পরীক্ষকরা চেখে দেখে স্বাদে ভালো বলেই জানিয়েছেন।
এছাড়া, জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে অণুজীবকে এমনভাবে রূপান্তর করা যায় যাতে খড়, কাঠের মতো অখাদ্য পদার্থ থেকেও প্রোটিন ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার তৈরি হয়। এ ধরনের খাদ্য মাংসের বিকল্প হতে পারে । এতে শুধু খাদ্য সংকটই কমবে না, বরং যেসব প্রাণীর মাংস খাওয়া হয় তাদের হত্যার হারও কমবে।
তবে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো ভোক্তাদের গ্রহণযোগ্যতা। সত্যি বলতে মানুষ নতুন ধরনের কোনো খাবার চট করে খেতে চায় না, বিশেষত তা যদি হয় ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস-ভিত্তিক কিছু। এই তো যেমন, ব্যাকটেরিয়া বার্গার শুনলেই অনেকেই ভ্রু কুঁচকায় নাক সিটকায় । সুতরাং , আপামর জনসাধারণের কাছে শুধু এটা কিভাবে তৈরি হচ্ছে তার থেকেও এর স্বাদের আনন্দ, স্বাস্থ্যগুণ এবং পরিবেশবান্ধব সুবিধা তুলে ধরতে হবে।

মোটকথা হল অণুজীবেরা আমাদের খাবারের অদৃশ্য এক রাঁধুনি। এদের রান্নার যাদুতে আমাদের প্লেটে যোগ হচ্ছে স্বাদের গভীরতা এবং পুষ্টি। ভবিষ্যতে খাদ্যে জোরকদমে অণুজীবের ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানীদের আরও স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ এবং সমাজের ইতিবাচক মনোভাব।

সূত্র : Microbes on the menu by Nature Microbiology Editorial (Published: 03 September 2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

13 − 3 =