অন্ধকারের উৎস হতে…

অন্ধকারের উৎস হতে…

Posted on ৬ এপ্রিল, ২০১৯

দৃশ্যমান জগতের সবকিছুই যে শেষ কথা নয়, আসলে আমাদের চারপাশের এই বস্তুসমূহ যে একটা হিমশৈলের চূড়া মাত্র— এটাই হল মূল কথা। আমরা চোখে দেখছি না অথচ রয়েছে, এমন অনেক কিছুরই কথা বলতে চলেছি এখন। মহাবিশ্বের সর্বত্রই, বিজ্ঞানীদের মতে আসলে যেটা ছড়িয়ে রয়েছে— সেই অদৃশ্য ‘ডার্ক ম্যাটার’, এবং ‘ডার্ক এনার্জি’ নিয়ে এই লেখা। আমাদের অজ্ঞানতার গহন অন্ধকারের মধ্যেই বাস করছে সে, সর্বত্র সে বিরাজমান হলেও কোন উৎস থেকে সে একদিন উৎসারিত হয়েছিল— তা এখনও অজানা।

‘ডার্ক ম্যাটার’ শব্দটার ভালো বাংলা আমি এখনও বানাতে পারিনি, আর আমার চোখেও পড়ে নি। ‘কৃষ্ণ পদার্থ’ বলতে পারতাম কিন্তু ‘Blackbody’-র (এটা এমন এক বস্তু, যার ওপর কোনো তরঙ্গ এসে পতিত হলে সে সেই তরঙ্গকে পুরোপুরি শুষে নেয়) বাংলা হিসেবে ‘কৃষ্ণবস্তু’ কথাটা সর্বত্র চলে বলে ‘কৃষ্ণ’ শব্দটা আমি ডার্ক ম্যাটারের প্রতিশব্দতে আনতে চাইছি না। তাই এই লেখায় ডার্ক ম্যাটারকেই রাখা হচ্ছে। আর নামে কী আসে যায়, বিষয়টা বুঝলেই তো হল…।

শুরুতে বলি অনেকের জানা কিছু কথা। আমরা বাস করছি যে গ্রহটিতে, সূর্যের চারপাশে পাক খেতে থাকা সেরকম আরও সাতটি গ্রহ আর কিছু উপগ্রহ-গ্রহাণু-বামন গ্রহ ইত্যাদি নিয়ে এই সৌরমণ্ডল। এর বাইরেও রয়েছে আরও বহু বহু সূর্যের মতো তারা, বহু কোটি তারা নিয়ে গড়ে উঠেছে ছায়াপথ, আবার বহু কোটি ছায়াপথ নিয়ে এক একটা ক্লাস্টার, বা ছায়াপথপুঞ্জ।

ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, এই সবকিছুর মধ্যে আমরা কত্ত ক্ষুদ্র। বাস্তবিকই সমগ্র মহাবিশ্বের এক অত্যন্ত ক্ষুদ্র অংশ এই সৌরমণ্ডল। তবে, সৌরমণ্ডলের কথা শুধু ভাবলে চলে না, মহাবিশ্বতত্ত্ব নিয়ে আলোচনার সময় এই সৌরমণ্ডলের বাইরে বহু বহু দূর অব্দি এলাকাকে আমাদের কল্পনায় নিয়ে আসতে হয়, যেটা বেশ কষ্টকর।

মহাবিশ্ব বলতে ইংরেজিতে আমরা ‘Universe’ কথাটা ব্যবহার করি। একে ‘ব্রহ্মাণ্ড’-ও বলা চলে। এই মহাবিশ্বের আকার, আয়তন, সৃষ্টি-প্রক্রিয়া, এর বিবর্তন, অন্তিম অবস্থা— ইত্যাদি নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানীরা বেশ নিবিড়ভাবে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আধুনিক যুগের উন্নত ধরণের সব টেলিস্কোপ, অন্যান্য সুক্ষ্ম যন্ত্রাদি এই গবেষণা করার রাস্তা মসৃণ করে তুলেছে। তা ছাড়া আকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনা করে সেখানে টেলিস্কোপ বসিয়ে মানুষ অতি দূর থেকে আসা অত্যন্ত ক্ষীণ আলোকেও বিশ্লেষণ করার ব্যবস্থা করে ফেলেছে, যেটা আমাদের জানাতে পারছে মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বহু অজানা কথা। আবার বেশকিছু পুরনো ধারণাকেও বদলানো সম্ভব হয়েছে সাম্প্রতিককালে।

যেমন, মহাবিশ্ব তার সমস্ত সদস্যকে নিয়ে অনাদিকাল ধরেই টিকে আছে— এটা ঠিক না। গ্রহ-নক্ষত্রদের যেমন বয়স আছে, তেমনই বয়স আছে এই মহাবিশ্বেরও— প্রায় চোদ্দশো কোটি বছর। ততদিন আগে
মহাবিশ্ব যে প্রসারণশীল, এটা অনেক বছর আগেই জানিয়েছিলেন (আসলে ১৯২৯ সালে) আমেরিকান বিজ্ঞানী এডউইন হাবল, তাঁর পরীক্ষালব্ধ ফল বিশ্লেষণ করে।

‘মহাবিশ্ব প্রসারণশীল’— কথাটা সহজে বললাম বটে, কিন্তু এর মধ্যে বেশ কিছু কথা আছে। মহাবিশ্ব বাড়ছে, মানে এই নয় যে এর মধ্যে থাকা সবকিছুই বেড়ে চলেছে। আমাদের চারপাশের কোনোকিছুই কিন্তু আসলে বাড়ছে না। যেটা বাড়ছে, তা হল ‘স্থান-কাল’ নামের একটি ধারণা। আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯০৫ এবং ১৯১৫ সালে— যথাক্রমে ‘বিশেষ’ এবং ‘সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ’ (Special & General theory of Relativirty) তত্ত্বে দেখিয়েছিলেন ‘স্থান’ (Space, অর্থাৎ আমরা যেখানে বাস করছি, আমাদের চারপাশের ত্রিমাত্রিক এলাকা) এবং ‘কাল’ (Time, অর্থাৎ সময়) একইসঙ্গে জড়িত, তাদের মধ্যে রয়েছে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। আমরা বাস করছি এই স্থান এবং কালের মিলিত প্রয়াসে গঠিত একটা অবস্থায়, যাকে চারমাত্রার ‘স্থান-কাল’ হিসেবে প্রকাশ করা হয়। স্থান-কালের এই সংযুক্ত রূপ কেমন হবে, সেটাও তিনি জটিল কিছু সমীকরণের সাহায্যে প্রকাশ করেছিলেন। স্থান-কালের এই রূপকে ভাবা যেতে পারে এক চার মাত্রার পর্দা মতো, যার মধ্যে থাকা যে কোনো বস্তু পর্দাটিকে প্রভাবিত করে (এই প্রভাবিত করাকে আইনস্টাইন এইভাবে বলেছিলেন— ‘Space-Time tells matter how to ’)। নিউটনের মহাকর্ষ বল সংক্রান্ত নিয়মটিকেও আইনস্টাইন সংশোধিত (বা বলা ভালো নতুন রূপে উপস্থাপিত) করলেন, তিনি বস্তু দ্বারা বস্তুকে আকর্ষণ করার ব্যাপারটাকে দেখালেন এমনভাবে— যেন সেটা প্রভাবিত করছে এই স্থান-কালের চতুর্মাত্রিক অবস্থাকে।

আইনস্টাইনের কথা অনুযায়ী চার মাত্রার এই প্রভাবিত হওয়াকে একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে সর্বত্র বোঝানো হয়ে থাকে— একটা টান টান করা রাখে পর্দার ওপর রাখা আছে লোহার একটি বল। বলটা না থাকলে পর্দা থাকে টান টান, বলটা রাখা হলে পর্দা তার ভারে নেমে যায়। অর্থাৎ বলটার নীচের পর্দাটা নেমে যায়। এই অবস্থায় বলটার কাছে একটা ছোট মার্বেল ছেড়ে দিলে দেখা যাবে মার্বেলটা বলটার চারপাশে পাক খেতে খেতে নেমে আসছে বলটার দিকে।

ঠিক এটাই হয় সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর পাক খাওয়ার সময়। সূর্য তার বড় আকার আর ভরের জন্য তার চারপাশের স্থান-কালকে দেয় বাঁকিয়ে, এই বক্রতা প্রভাবিত করে আসে পাশে থাকা গ্রহগুলিকে। তারা বাধ্য হয় সূর্যের চারপাশে ঘুরতে। তবে, একটা পার্থক্য, পর্দার উদাহরণটা ত্রিমাত্রিক তলে, স্থান-কালের বক্রতা ঘটছে চারমাত্রায়।

হাবল-এর মতে, মহাবিশ্বের প্রসারণ আসলে এই স্থান-কালেরই প্রসারণ। এখানেও একটা ভালো উদাহরণ দেওয়া হয়ে থাকে বিভিন্ন জনপ্রিয় বিজ্ঞান বইতে— একটা না ফোলানো বেলুনের গায়ে কলম দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকটা ছোট ফুটকি-দাগ দিয়ে দেওয়া হল। এবার বেলুনটাকে ফোলানো হলে দেখা যাবে, ফুটকিগুলোর মধ্যে দূরত্ব বেড়ে গেছে। কিন্তু তাদের আকারের খুব একটা বৃদ্ধি ঘটেনি। একই ব্যাপার ঘটছে মহাবিশ্বের বেলাতেও। এখানে স্থান-কালের আয়তন যত বাড়ছে, গ্রহ-নক্ষত্রদের মধ্যে দূরত্বও ততই বেড়ে চলেছে। তবে তাদের বেলা এই বেড়ে যাওয়াটা অতটা সহজে পরিমাপযোগ্য নয়। বিজ্ঞানীরা বড় আকারের মহাজাগতিক বস্তু, যেমন ছায়াপথগুলির মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটার প্রমাণ পেয়েছেন।

তবে, এখানে বলে রাখা ভালো যে মহাবিশ্ব বেড়েই চলেছে— এতে আমাদের ভয়ের কিছু নেই। আমরা এই বেড়ে যাওয়াটা কোনোভাবেই, কোনোদিন বুঝতে পারব না। বিজ্ঞানীরা খুব সুক্ষ্ম হিসেবনিকেশ করে তবে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছেন। এর জন্য যে সব ঘটনা ঘটবে সুদূর ভবিষ্যতে, সেসব দেখার জন্য কোনো মানুষ থাকবে না ততদিন।

মহাবিশ্ব তো বেড়ে চলেছে এটা জানা গেল, কিন্তু সেই বেড়ে চলাটা কীরকম? মানে, সেই বর্দ্ধমান অবস্থাটা কি চিরকাল একইরকম, নাকি সেটাও পরিবর্তনশীল?
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে অব্দি বিজ্ঞানীরা জানতেন যে মহাবিশ্বের এই প্রসারণ যেমনই হোক, একে উলটোদিকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট শক্তি এবং ভর মহাবিশ্ব ধারণ করে আছে। এই প্রসারণ আস্তে আস্তে কমতে থাকবে, তবে কখনই হয়তো পুরোপুরি থেমে যাবে না। উলটোদিকের এই টানের প্রধান কারণ মহাকর্ষ বল। যেটা দুটি বস্তুকে টেনেই রাখে, সে তারা যত দূরেই থাক। দুটি বস্তুর মধ্যে দূরত্ব বাড়লে এই টান কমে আসে, দূরত্বের বর্গের সঙ্গে টানের মান ব্যস্ত-অনুপাতে পালটায়।

কিন্তু তাঁরা ধারণা বদলাতে বাধ্য হলেন ১৯৯৮ সালে, যখন জানা গেল যে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে ত্বরিত বেগে, অর্থাৎ এই প্রসারণের বেগ, বা হার বেড়েই চলেছে। এটা খুব বড় একটা আবিষ্কার, অন্তত ‘মহাবিশ্বতত্ত্ব’ জগতে।

২/১৯৯৮ সালে ঠিক কী ঘটেছিল?
দুটি বিজ্ঞানীর দল ‘হাবল স্পেস টেলিস্কোপ’ নিয়ে গবেষণা করছিলেন অনেক দূরের ‘সুপারনোভা’ (মহাজাগতিক এক বিস্ফোরণ, এই প্রসঙ্গে পরে আবার আসব) নিয়ে। আসলে তাঁদের লক্ষ্য ছিল অন্য। মহাবিশ্বের প্রসারণের হার ক্রমশ কমছে, এটাই তাঁরা ধরে নিয়ে এগোচ্ছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য এই কমতে থাকা প্রসারণের হার নির্ণয় করা। কিন্তু পরীক্ষা করে পাওয়া ফলাফল বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখলেন, ব্যাপারটা পুরো উলটো। মহাবিশ্বের প্রসারণ তো কমছেই না, উলটে বেড়েই চলেছে। অনেক দিন আগে (অনেক দিন আগে দু’চার বছর আগে নয়, বহু কোটি কোটি বছর আগে) মহাবিশ্বের প্রসারণের হার এখনকার চেয়ে কম ছিল। তাঁরা এই ঘটনার ব্যাখ্যা সহজে দিতে পারলেন না।

যদিও এর আগেও বেশ কিছু পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা এই প্রসারণের প্রমাণ পেয়েছিলেন। তবে ব্যাপারটা একেবারে নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হল এই ঘটনার পরেই।

কিন্তু আসল প্রশ্নটা এল এর পরেই। কেন মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে অকল্পনীয় বেগে? তার প্রসারণ কমছেই না কেন? বেড়েই চলছে কেন? এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার কাজটা কিন্তু সহজ নয়।

শুরুতে অনেকে ধরে নিলেন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বই হয়তো ভুল, রয়েছে অন্য কোনো নিয়ম, যা ব্যাখ্যা করতে পারবে এই ঘটনাকে।

না অত সহজে সেটাও বলা যায় না, কারণ এই আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বকে এর আগে সফলভাবে বিভিন্ন পরীক্ষায় সত্যি বলে প্রমাণ করে দেখা হয়েছে। তবে যেহেতু মহাবিশ্ব প্রসারিত হয়েই চলেছে, এর কয়েকটা সম্ভাব্য কারণ বিজ্ঞানীরা অনুমান করলেন—
এক) মহাবিশ্বের মোট শক্তি ঘনত্বের (অর্থাৎ মোট যা শক্তি রয়েছে) পঁচাত্তর শতাংশ কোনো অজানা ধরনের শক্তি দিয়ে পূর্ণ, যার সঠিক উপাদান বা প্রকৃতি এখনও আমাদের অজানা,
দুই) হয়তো আইনস্টাইনের এককালে প্রস্তাবিত সেই ‘মহাজাগতিক ধ্রুবক’কে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে, (এই ব্যাপারটায় পরে আসছি) ; যার সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যাবে বহির্মুখী এই টানকে।
তিন) খুব বড় মাপের স্থান-কাল অর্থাৎ মহাজাগতিক হিসেবপত্তর করার সময় আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ ঠিকঠাক কাজ করছে না, এর বদলে অন্য কোনো তত্ত্ব আনা প্রয়োজন।

হ্যাঁ, সেই রকম এক তত্ত্ব হিসেবে বিজ্ঞানীরা এটাও ধারণা করেছেন যে, আমাদের এই চার মাত্রার স্থান-কাল আসলে আরও বেশি মাত্রার কোনো এলাকায় নিমজ্জমান— বাকি মাত্রাগুলোকে আমরা বুঝতে পারছি না, এই যা। যেমন আমরা খালি চোখে এক্স রশ্মি দেখতে পাই না, তেমনই এই বেশি মাত্রার স্থানকে আমাদের ধারণায় আনতে পারি না। মহাকর্ষ বল এই বাড়তি মাত্রাগুলিতে কোনোভাবে ছ্যাঁদা করে চলে যাচ্ছে, যে জন্য তার প্রভাব কমে যাচ্ছে মহাজাগতিক বস্তুদের ওপর, আর সেই কারণেই সবকিছু সবকিছু থেকে সরে যাচ্ছে দূরে।
এটা একটা মতামত। এইরকম আরও মতামত আছে। যেমন, এমনও বলা হয়, মহাকর্ষ বলের মান, বা প্রভাব মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নরকম। আমরা যেখানে আছি, এখানে এই প্রভাবটা এমনই যে আমরা টিকে থাকতে পারছি, অন্যত্র হয়তো এই বলের রূপ অন্যরকম হবে।
তবে, বিভিন্ন দিক খতিয়ে বিজ্ঞানীরা আপাতত সিদ্ধান্তে এসেছেন, মহাবিশ্বে রয়েছে এমন কিছু অদৃশ্য পদার্থ এবং লুকায়িত শক্তি— যেগুলি এ যাবতকালে আবিষ্কৃত যন্ত্রাদি দ্বারা পরিমাপযোগ্য নয়। এই অদৃশ্য বস্তু এবং শক্তিই দায়ী মহাবিশ্বের বহির্মুখী প্রবল টানের জন্য। এই বস্তুকেই নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডার্ক ম্যাটার’, এবং শক্তিকে ‘ডার্ক এনার্জি’।

‘ডার্ক ম্যাটার’ এবং ‘ডার্ক এনার্জি’ নিয়ে কিছু বলার আগে আমাদের দৃশ্যমান জগতের বস্তু-উপাদান আর সাধারণ শক্তি নিয়ে কিছু কথা বলে নিই। সেই সঙ্গে বস্তুকে ‘দেখা’র বিবিধ উপায়গুলি সম্বন্ধেও কিছু জেনে নেব।

৩/এই জগতে, আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখছি, তার সবই আপাতত আমরা জানি কী কী দিয়ে তৈরি। প্রতিটি বস্তুর অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকৃতি অণু পরমাণু দিয়ে তৈরি, যে পরমাণু আবার তৈরি হয় ইলেকট্রন প্রোটন আর নিউট্রন নামের তিনরকম অতি ক্ষুদ্র কণা দিয়ে। ইলেকট্রনেরা ঋণাত্মক তড়িৎ যুক্ত, প্রোটন ধনাত্মক তড়িৎ বহন করে, আর নিউট্রনের তো কোনো আধানই নেই। পরমাণুর মধ্যে নিউক্লিয়াস নামক অতি অল্প এলাকায় ঠাসাঠাসি করে থাকে প্রোটন আর নিউট্রনেরা, আর তাদের চারপাশে বিভিন্ন কক্ষপথে ঘোরে ইলেকট্রনেরা।

পরের দিকে, বিজ্ঞানীরা আরই দেখিয়েছেন, এই প্রোটন আর নিউট্রনেরা আবার আরও ক্ষুদ্র কণার সমন্বয়ে গঠিত— যাদের নাম ‘কোয়ার্ক’। এরাও আধান বহন করে, তবে এরা কখনও আলাদা থাকতে পারে না। ‘কোয়ার্ক’দের নিয়ে গবেষণা এখনও চলমান, তবে এটুকু বলা যায় নিশ্চিতভাবে— এই কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি কণাদের বলা হয় ‘ব্যারিয়ন’, আর এই ব্যারিয়ন কণা দিয়েই তৈরি মহাবিশ্বের যাবতীয় দৃশ্যমান বস্তুসমূহ।

আরও বহুরকমের অতি ক্ষুদ্র কণা রয়েছে জগতে, সেগুলি হয়তো এমনই সময়ে কোথাও নেই, তবে বিভিন্ন কৃত্রিম উপায়ে সেগুলিকে বিজ্ঞানীরা অতি ক্ষুদ্র সময়ের জন্য ইচ্ছে করলে তৈরি করে ফেলতে পারেন। এইভাব আবিষ্কৃত হয়েছে কয়েকশো কণা।

এছাড়াও রয়েছে ফোটন নামের এক কণা, সাধারণ দৃশ্যমান আলো যে কণা দিয়ে তৈরি। শুধু দৃশ্যমান আলোই না, অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী এক্স রশ্মি, গামা রশ্মি থেকে শুরু করে অপেক্ষাকৃত দুর্বল কিন্তু প্রয়োজনীয় রেডিও তরঙ্গ, অবলোহিত তরঙ্গ, বা ক্ষতিকারক অতিবেগুনী রশ্মি— এই সবই ফোটন কণার স্রোত আসলে।

এছাড়াও রয়েছে ‘নিউট্রিনো’ নামের এক ক্ষুদ্র কণা— যারা মহাবিশ্বে ছেয়ে রয়েছে অজস্র। এদের ভর অতি সামান্য, সাধারণ পদার্থের সঙ্গে যোগাযোগে প্রভাবিতও করে সামান্য, প্রায় করেই না। তাই এদের মেপে ওঠা, বা হাতেনাতে পাকড়াও করা খুবই কঠিন। মহাবিশ্ব থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে এই কণা পৃথিবীতে আসছে প্রতিনিয়ত, আমরা বুঝে ওঠার আগেই তারা আবার আমাদের ভেদ করে চলে যাচ্ছে অন্য দিকে। তবে খুব ক্ষুদ্র হলেও বিজ্ঞানীরা এই কণার অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছেন নিশ্চিতভাবে।
এখানেই শেষ নয়, রয়েছে কিছু প্রতি-কণাও। যাদের বলে ‘Anti-particle’। যেমন ইলেকট্রনের প্রতি-কণার নাম ‘অ্যান্টি-ইলেকট্রন’, বা প্রোটনের প্রতি-কণার নাম ‘অ্যান্টি-প্রোটন’। এদের নিয়ে আপাতত বেশি কিছু না জানলেও চলবে, শুধু এটুকু বলে রাখা যাক— কোনো অ্যান্টি-কণা যখন তার মূল কণার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন উৎপন্ন হয় কিছু শক্তি— যেটা বেরিয়ে যায় গামা রশ্মি হিসেবে।

মহাবিশ্বে সাধারণ বস্তুকণা যেমন রয়েছে সর্বত্র, তেমনই অস্তিত্ব রয়েছে প্রতি-কণাও, তবে তাদের পাওয়া যায় শুধুমাত্র পরীক্ষাগারে, খুব অল্প সময়ের জন্য বিশেষ কিছু পরীক্ষায় এঁরা হাজির হন, আবার মিলিয়ে যান কিছু শক্তির অবশেষ রেখে। মহাবিশ্ব কেন শুধু পদার্থ দিয়েই তৈরি, সেখানে নেই কোনো প্রতি-পদার্থ— এর কারণ বিজ্ঞানীদের এখনও অজ্ঞাত।
এবার আসি বস্তুকে ‘দেখা’র প্রসঙ্গে। কোনো জিনিসকে আমরা কখন দেখতে পাই?
না, ‘চোখ আছে তাই দেখতে পাই’ গোছের উত্তর দিলে তো চলবে না। ছোটবেলার বিজ্ঞান বইতেই তো পাওয়া যায় এর উত্তর। যে কোনো বস্তুর ওপরে আলো পড়লে বস্তুটি সেই আলোর কিছুটা ফিরিয়ে দেয়। সেই ফিরে আসা আলো আমাদের চোখে এসে পড়লে আমাদের চোখের ভিতরে বস্তুটির একটা প্রতিবিম্ব তৈরি হয়, সেটাকেই অনুভব করি মস্তিষ্কের সংশ্লিষ্ট এলাকায় সঙ্কেত পাঠিয়ে, আমাদের মাথার মধ্যে আগে থেকে সঞ্চিত জ্ঞান, বা অভিজ্ঞতা আমাদের জানিয়ে দেয়, বস্তুটা কী।
এখন এটা সহজেই বোঝা যায়, অন্ধকারে আমরা কোনো জিনিসের দিকে তাকালে দেখতে পাই না, কারণ অন্ধকারে বস্তুতে গিয়ে কোনো আলোই পড়তে পারে না, তাহলে তা থেকে আমাদের চোখেই বা আলো আসবে কী করে, আর আমরা তাকে দেখবই বা কী করে।

আবার যদি কেউ বলে যে আমাদের সামনে এমন বহু কিছু জিনিস ছড়িয়ে রয়েছে, যার নাগাল পাচ্ছে না আলো, তখন সে ক্ষেত্রে আমরা তো সেই জিনিসটাকে দেখতেই পাব না। সে আমাদের সামনে থেকেও হয়ে থাকবে অদৃশ্য। এমনটাও কি বাস্তবে হতে পারে?
অনেকে বলবে, কেন আমাদের সামনে কত অজস্র ভূত ঘোরাফেরা করছে, তাদের তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না। হ্যাঁ, ভূতেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে বটে, তবে এই আলোচনায় তাদের আমরা বিরক্ত করব না। ভূত-প্রেতাত্মা, আত্মা এই সব অপ্রাকৃত ঘটনা আমরা আপাতত একটু এড়িয়ে চলব।

তা যেটা বলছিলাম, আমাদের চারপাশে কিছু এমন পদার্থ নিশ্চিতভাবেই রয়েছে, যাদের আলো ফেলে কোনোভাবেই ‘দেখা’ সম্ভব না। দেখা কথাটাকে বিশেষ করে উল্লেখ করলাম, কারণ আমাদের খালিই চোখে দেখার বাইরেও আরও অনেকভাবে দেখার বন্দোবস্ত রয়েছে বিজ্ঞানীদের কাছে। তার একটা হল ইনফ্রারেড (বা অবলোহিত) টেলিস্কোপ।
আমরা জানি, সাধারণ আলো, যে আলোগুলিকে আমরা দেখতে পাই, যেমন লাল, নীল, সবুজ আলো— সেগুলি ছাড়াও পরিবেশে আরও বহু প্রকার আলোর অস্তিত্ব রয়েছে, যেগুলি কোনো সাধারণ যন্ত্রেও ধরা পড়ে না। অনেক বছর আগে স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল বলেছিলেন, আলো আসলে একরকম তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ, যা বাতাস বা শূন্য মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে যায় সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার বেগে।
এই আলো ছাড়াও আরও বহুপ্রকার ‘আলো’, বা তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ রয়েছে, যেগুলিকে আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। এদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা কম্পাঙ্ক— এসবই সাধারণ আলোর চেয়ে কম বেশি, এই কম বেশির পাল্লা যথেষ্টই লম্বা। এগুলির মধ্যে রয়েছে, গামা তরঙ্গ, অতিবেগুনি তরঙ্গ, অবলোহিত, এক্স রশ্মি, রেডিও তরঙ্গ ইত্যাদি। এদের কম্পাঙ্ক বা তরঙ্গদৈর্ঘ্য সাধারণ আলোর চেয়ে কম বা বেশি, আমাদের চোখে এরা ধরা পড়ে না। তবে যন্ত্রের চোখে সকলেই ধরা পড়তে বাধ্য।
এমনিতে আকাশের দিকে তাকালে, অন্ধকারে আমরা যে অজস্র তারাদের দেখতে পাই, ওরা সবাই তো মিটমিট করে আলো দেয় বলেই ওদের আমরা দেখতে পাই। তবে এরা সকলেই যে দৃশ্যমান আলোই শুধু বিকিরিত করে, এমনটা নয় কিন্তু। এর সঙ্গে বহু দূরের তারারা থেকে আসে নানারকমের অদৃশ্য তরঙ্গ, যেগুলির নাম আগেই বলেছি। এই তরঙ্গগুলিকে শনাক্ত করার যন্ত্রও রয়েছে। সুতরাং বহু দূরের তারা থেকে আসা ক্ষীণ আলোকে বিজ্ঞানীরা যন্ত্রে নিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখতে পারেন এবং জানতে পারেন মহাবিশ্ব নিয়ে নানা তথ্য। ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ সেইরকমের এক যন্ত্র, যার মধ্যে দিয়ে ইনফ্রারেড আলো প্রবেশ করে যে যে বস্তু থেকে সে আসছে, তার প্রতিবিম্ব গঠন করতে পারে।

৪/ডার্ক ম্যাটার বিজ্ঞানের জগতে এক ধাঁধা, যেটার সমাধান খুঁজে চলেছেন অজস্র বিজ্ঞানী। এই পদার্থ আসলে কী দিয়ে তৈরি, এদের মূল উপাদান কী, বিবর্তন ঘটে কীসে পরিণতি লাভ করতে পারে, এমন সব তথ্যের সন্ধান চলছেই। বলা হচ্ছে, ডার্ক ম্যাটারের রহস্য সমাধান করা গেলে মেলানো যাবে বিজ্ঞানের দুই শাখা— মহাবিশ্বতত্ত্ব (Cosmology) আর মৌলকণাবিদ্যা (Elementary particle physics)কে। কারণ, অতি ক্ষুদ্র কণাজগতের সঙ্গে অতি বৃহৎ মহাকাশ, এই দুইএর মধ্যে যোগসূত্র ওই ডার্ক ম্যাটার, যার উপাদান বা ধর্ম খুঁজে চলেছে ‘ক্ষুদ্র কণাবিদ্যা’, আর মহাকাশে যার আবাসস্থল খুঁজে চলেছে ‘মহাবিশ্বতত্ত্ব’।
আধুনিক বিজ্ঞানের বিষয় হলেও এই ডার্ক ম্যাটার শব্দটি কিন্তু অনেক পুরনো। ফ্রিৎজ জুইকি (১৮৯৮- ১৯৭৪) ‘ডার্ক ম্যাটার’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। তিনি কাজ করতেন ক্যালটেকে, রবার্ট মিলিকান ছিলেন তাঁর সহকর্মী। জুইকি মূলত মহাজাগতিক রশ্মি বা ‘কসমিক রে’ নিয়ে কাজ করতেন। ১৯৩৩ সালে ‘কোমা’ গ্যালাক্সি নিয়ে কাজ করার সময় তিনি দেখেন এই গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের পরিমাপ করে যা ওজন পাওয়া যাচ্ছে, তা এর আলোক- উজ্জ্বলতা থেকে প্রাপ্ত ওজনের প্রায় চারশো গুণ। এই দেখে তিনি মনে করেন এই ছায়াপথের বেশিরভাগটাই নির্ঘাত অন্ধকার কোনো পদার্থ দিয়ে তৈরি, যার নাগাল মিলছে না। তখন তিনি এই অজানা পদার্থের নাম দেন ‘ডার্ক ম্যাটার’।

এই মহাবিশ্বের মোট ভরের, ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, মাত্র চার কি পাঁচ শতাংশ হল আমাদের চেনা পদার্থ, বাকি সবই অচেনা। বাকি ছিয়ানব্বই শতাংশের মধ্যে প্রায় আটষট্টি শতাংশ হল ডার্ক এনার্জি, আর সাতাশ শতাংশ হল ডার্ক ম্যাটার।
ডার্ক ম্যাটার কী জিনিস, সেটা বলার চেয়ে সেটা কী নয়— সেটা বলতেই বিজ্ঞানীরা বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। প্রথমত এটা কোনো কালো বা অন্ধকার বস্তুই না। ‘ডার্ক’ কথাটা বলা হচ্ছে শুধুই এর অস্তিত্ত্ব আমাদের কাছে অন্ধকারে আচ্ছন্ন বলেই। সে ‘অন্ধকার’ সবদিক দিয়েই— আমাদের জ্ঞানের পরিধির বাইরে বলে, আবার আমাদের এতদিনকার সমস্তরকম যন্ত্রাদির সাহায্যে তার অস্তিত্ত্ব প্রমাণ করতে ব্যর্থ বলেও।

তা ছাড়া, এই পদার্থের কণা আমাদের জানাচেনা কোনোরকম ব্যারিয়ন জাতীয় কণা নয়, বা এটা কোনো ‘প্রতি-পদার্থ’ও নয়। কারণ, প্রতি-পদার্থরা যখন সাধারণ পদার্থের সঙ্গে মিলিত হয়, বেশ কিছু গামা রশ্মি নির্গত হয়, যেটা ডার্ক ম্যাটারের সঙ্গে সাধারণ পদার্থের কোনোরকম মোলাকাতের সময় নির্গত হয় না।

আর, আমরা বড় আকারের ব্ল্যাক হোল-দেরও এই ডার্ক ম্যাটার হওয়ার সম্ভাবনা থেকে সরিয়ে রাখতে পারি, কারণ ডার্ক ম্যাটার আলোকে তার পাশ থেকে আসার সময় কোনোভাবেই প্রভাবিত করে না, যেটা ব্ল্যাক হোল করে।
তবু বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত, ডার্ক ম্যাটার আছেই।

এ জন্য আজ বেশ কিছু দেশের বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে কাজ করে চলেছেন ডার্ক ম্যাটারের সন্ধানে। ‘CERN’ নামের সেই ইউরোপীয় সংস্থা, যারা বছর কয়েক আগে হিগস বোসন কণার সন্ধানে এক বিপুল কর্মযজ্ঞ চালিয়েছিলেন, সেখানকার বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী ডার্ক ম্যাটার তৈরির চেষ্টা করছেন পরীক্ষাগারে।

আর, এঁদের বিপরীতে আছেন এমন কিছু বিজ্ঞানী— যাঁরা মনে করছেন মহাকর্ষ সূত্র— সে নিউটনের হোক, বা আইনস্টাইনের, সেই নিয়মগুলি আসলে দু’রকম— আমাদের নাগালের মধ্যে থাকা বস্তুজগতের জন্য একরকম, আর অতি দূরের বিশাল সব মহাজাগতিক বস্তুদের জন্য অন্যরকম।

বেশ কিছু পদার্থকে আন্দাজ করা হয়েছে ডার্ক ম্যাটার হিসেবে, সেগুলোর কথা একটু বলি।
যেমন রয়েছে ‘WIMP’ নামের এক কণা, যার পুরো কথা— Weakly Interacting Massive Particles, অর্থাৎ এমন কিছু ভারী বড় আকারের কণা, যারা সাধারণ বস্তুকণার সঙ্গে খুব অল্প সংযোগ ঘটায়, এদের খুঁজে পাওয়াও তাই খুব মুশকিল। এই কণার ভর একটা প্রোটনের ভরের ভগ্নাংশ থেকে কয়েক হাজার গুণ অব্দিও হতে পারে।
সাধারণত তিন রকমের নিউট্রিনো মেলে পরিবেশে। তবে চতুর্থ এক ধরনের নিউট্রিনো আছে বলে মনে করা হয়, যার নাম ‘Sterile Neutrino’। একেও অনেকে মনে করেন ডার্ক ম্যাটার হিসেবে।
***
ডার্ক ম্যাটার নিয়ে কাজ চলছে অনেক দেশেই, এবার সেরকম কয়েকটি গবেষণাকেন্দ্রের নাম বলি।
ক/ AMS, আলফা ম্যাগনেটিক স্পেক্ট্রোমিটার— মহাকাশে যে ‘আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র’ বা ইন্টারন্যাশানাল স্পেস স্টেশন স্থাপিত আছে, সেখানে এই সুক্ষ্ম কণা-অস্তিত্বসন্ধানকারী যন্ত্রটি বসানো হয়েছে ২০১১ সালে। এখনও পর্যন্ত প্রায় দশ হাজার কোটি মহাজাগতিক রশ্মিকে বিশ্লেষণ করেছে এই যন্ত্র।
খ/ LUX, লার্জ আন্ডারগ্রাউন্ড জেনন ডার্ক ম্যাটার এক্সপেরিমেন্ট— আমেরিকার দক্ষিণ ডাকোটায় অবস্থিত একটি গবেষণাকেন্দ্র। এখানেও কাজ চলছে, এখনও কোনো সাফল্য আসেনি।
গ/ আইসকিউব নিউট্রিনো অব্জারভেটরি— আক্টার্কটিকায় অবস্থিত একটি কেন্দ্র, যেখানে স্টেরাইল নিউট্রিনোর সন্ধান চলছে। এই কণার কথা আগেই বলেছি।
ঘ/ নাসা নামের আমেরিকান মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ২০১৪ সালে একটি যন্ত্র বসায়— ‘ফার্মি গামা রে স্পেস টেলিস্কোপ’ নামে, যে যন্ত্র আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের একেবারে কেন্দ্রের মানচিত্র তৈরি করে ফেলে, এবং কাজটা করা হয় সম্পূর্ণ গামা রশ্মির সাহায্যে। দেখা যায় এই কেন্দ্রে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে গামা রশ্মি। এই ঘটনার ব্যাখ্যা মেলে নি, তাই মনে করা হচ্ছে এই ছায়াপথের কেন্দ্রে রয়েছে বেশ কিছু ডার্ক ম্যাটার। তবে নিঃসন্দেহে বলার সময় এখনও আসেনি।

৫/ তবু কীভাবে বিজ্ঞানীরা নিঃসংশয় হলেন এই ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বের ব্যাপারে? এবার সেরকম কয়েকটি প্রমাণের কথা বলা যাক।
ক) স্পাইর‍্যাল গ্যালাক্সি বা সর্পিল ছায়াপথের কেন্দ্রে এবং বাইরের দিকের তারাদের বেগের তফাত। এই ছায়াপথগুলিকে দেখতে হয় চ্যাপ্টা, অনেকটা ডিস্কের মতো। এর কেন্দ্রে থাকে পরমাণুর ভারী নিউক্লিয়াসের মতো তারাসমষ্টি, আর তার চারপাশে অনেকগুলি শুঁড়ে পাক খায় আরও অজস্র তারামণ্ডলী।
বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়ম অনুসারে, একটা সর্পিল ছায়াপথের কেন্দ্রে থাকা তারাগুলি যে বেগে ঘোরে, ছায়াপথটির বাইরে পরিধির কাছে থাকা তারাগুলি তার চেয়ে অনেক কম বেগে ঘোরা উচিত কারণ, ছায়াপথগুলির মোট ভরের বেশিরভাগটাই থাকে কেন্দ্রের দিকে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে ঘটছে ঠিক এর উলটো। সেখানে কেন্দ্রের তারারা হোক কি বাইরের দিকের তারা, সকলের ঘোরার বেগ কম-বেশি প্রায় একই। এই ঘটনার একটা ব্যাখ্যা এইভাবে দেওয়া সম্ভব— যদি বাইরের দিকের তারাগুলি সেই ছায়াপথকে ঘিরে ছড়িয়ে থাকা একটা অদৃশ্য বস্তুর টান অনুভব করে, তবে তাদের বেগ কেন্দ্রের তারাদের মতই হবে।
ডার্ক ম্যাটার কীরকম হতে পারে, তার কিছুটা আন্দাজ দেন কেউ কেউ। যেমন, অনেকে বলেন, এই পদার্থ সাধারণ আমাদের চেনা পদার্থের সঙ্গে কোনোরকম সংযোগ ঘটায় না, অর্থাৎ এই দুই দলের মধ্যে কখনই কোনো সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এরা সাধারণ বস্তুর ওপর মহাকর্ষীয় বল প্রয়োগ করে।
খ) একটা বিশেষ ধরনের ‘সুপারনোভা’। অর্থাৎ বিশাল বিস্ফোরণ। যে বিস্ফোরণে ফেটে যায় গোটা নক্ষত্র। আর তা থেকে নির্গত হয় প্রচুর আলো, অর্থাৎ শক্তি। এই সুপারনোভা ঘটার ফলে থেকে যে আলো আসে এই পৃথিবীতে বসানো কোনো শনাক্তকারী যন্ত্রে, তবে তা থেকে হিসেব করে বলা যায় ওই তারাটির দূরত্ব। আর, সেই দূরত্বের পাশাপাশি সেই তারাটি যে ছায়াপথের অন্তর্গত, সেই ছায়াপথের ‘লাল সরণ’ বা ‘Red Shift’-এর পরিমাণ মেপে আমরা জেনে নিতে পারি সেই ছায়াপথটির আমাদের থেকে সরে যাওয়ার হার, বা পরিমাণ। একটা আলোক উৎস যখন আমাদের থেকে দূরে সরে যায়, তখন তা থেকে নির্গত আলোর বর্ণালী সরে যায় লাল আলোর দিকে, এই ঘটনাকে বলে রেড শিফট, বাংলায় লাল সরণ। বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান ডপলার এই ব্যাপারটা আবিষ্কার করেন।
তো, ২০১৪ সালে একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণকে খতিয়ে দেখে জানা যায়, এই বিস্ফোরণ ঘটার জন্য যে শক্তি প্রয়োজন, সেটা ছিল না সেখানে। এই অতিরিক্ত শক্তি মিলেছিল ডার্ক ম্যাটার থেকেই। আর ডার্ক ম্যাটারের থেকে পাওয়া শক্তি যেহেতু সাধারণ বস্তুকে বাইরের দিকে টানে, তাই এই বিস্ফোরণ।

৬/ এবার আসা যাক ডার্ক এনার্জির কথায়।
এর উপাদান আমাদের সম্পূর্ণই প্রায় অজানা। মহাশূন্যে কত শতাংশ এই শক্তি রয়েছে সেটা শুধু জানি। প্রায় সাতষট্টি শতাংশ। এই শক্তি পুরোপুরি স্থান-এরই একটা ধর্ম। আর তাই স্থান-কাল প্রসারিত হলে এই শক্তিরও বৃদ্ধি ঘটে। অর্থাৎ বর্ধিত স্থানকে ভরিয়ে ফেলার জন্য ডার্ক এনার্জিও নিজেকে বর্ধিত করে ফেলে। আর স্থান-কে আরও বাড়তে প্রলুব্ধ করে। ফলে একটা শৃঙ্খল বিক্রিয়ার মতো স্থান-কালের প্রসারণ বাড়িয়েই চলে ডার্ক এনার্জিকে, আর ডার্ক এনার্জির বৃদ্ধি বাড়িয়ে চলে মহাবিশ্বকে।
ডার্ক এনার্জি, অনেকে বলেন যেন আইনস্টাইনের সেই ‘মহাজাগতিক ধ্রুবক’-এর মতো— যেটা তিনি তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ সংক্রান্ত সমীকরণে ব্যবহার করেছিলেন মহাবিশ্বের প্রসারণকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে। এই ধ্রুবক যেন অভিকর্ষ বলের বিরুদ্ধে কাজ করছে, এর প্রকৃতি যেন বিকর্ষণ বলের মতোই। তিনি মনে করতেন মহাবিশ্ব আসলে স্থির, এর প্রসারণ বা সংকোচন কিছুই ঘটছে না। পরে যদিও তিনি হাবল সাহেব-এর পরীক্ষালব্ধ ফলাফল দেখে নিজের ভুল বুঝেছিলেন এবং এই ধ্রুবক প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।
এই ধ্রুবকটি ব্যবহার করা তাঁর জীবনের ‘Biggest Blunder’— এমনটাও বলেছিলেন তিনি।
আজ আমরা দেখছি, মহাবিশ্বের ক্রমবর্ধমান প্রসারণকে ব্যাখ্যা করার জন্য যেন প্রয়োজন পড়েছে আবার সেইরকম একটা ধ্রুবকের।
আজকের যুগে এসে, ডার্ক ম্যাটার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমরা দেখছি মহাবিশ্বের এই যে বর্ধিত হতে থাকা, এটা থেকেই পাওয়া যায় বিগ ব্যাং তত্ত্বের মূল কথা। সে আর এক পর্ব। আর এক দিনের জন্য।।