
ভারতে আগে ঘোড়া ছিল না। এখানকার গরম, আর্দ্র আবহাওয়া অশ্ব-প্রজননের উপযোগী নয়।
অথচ ভারতের ইতিহাস আর পুরাণে ঘোড়ার ব্যাপক উপস্থিতি। অর্জুন আর কৃষ্ণর ঘোড়ায় টানা রথ। কল্কির বাহন ঘোড়া। গৌতম বুদ্ধ রথে করে শহর পরিক্রমা করতেন, কিন্তু প্রাসাদ ছাড়েন ঘোড়ার পিঠে চেপে। জৈন তীর্থঙ্কর সম্ভবনাথ-এর প্রতীক হল অশ্ব। বিষ্ণুর হয়গ্রীব (হয়=ঘোড়া) নামে একটি রূপ আছে যিনি একটি ঘোড়ার মাথাওয়ালা দানবকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া নিম্নবর্গীয় জনসমাজে তো ঘোড়সওয়ার ঠাকুরদেবতার ছড়াছড়ি। কোথা থেকে এল এত ঘোড়া?
এল বাইরে থেকে। ভারত চিরকালই ঘোড়া আমদানি করত। ভূগোল, ইতিহাস আর প্রযুক্তি এর সঙ্গে জড়িত। জলবাহিত আর স্থলবাহিত হয়ে ঘোড়া ভারতে আসত মধ্য এশিয়া আর ইরান থেকে। অশ্ব-প্রজননপটু অ-ভারতীয়রা তিনটি তরঙ্গে ভারতে হানা দিয়েছিল। প্রথম তরঙ্গটি আর্যদের। জিন বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করা গেছে যে তৃণপ্রান্তর চারণভূমি থেকে দলে দলে মানুষ খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ নাগাদ ভারতে আসে। এর ফলে ভারতের জিন মানচিত্র বদলে যায়। আধুনিক জিনতত্ত্বর সাহায্যে এর অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্থানীয় স্ত্রী-ক্রোমোসোমের সঙ্গে মেশে নতুন পুরুষ ক্রোমোসোম। আর এই জিন-চিত্রবদলের পাশাপাশিই ঘটে ঘোড়ায়-টানা অর(স্পোক)-ওয়ালা চাকা বসানো রথের আবির্ভাব।
আর্যরা, মানে ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর তৃণভুমি-চারণকারীদের দক্ষিণ ইন্দো-ইরানি শাখার মানুষ খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ নাগাদ ঘোড়াকে বশ করে দুই ঘোড়ায় টানা অর-লাগানো চাকাওয়ালা হালকা রথ বানাতে পেরেছিল। এই অভিনব সামরিক প্রযুক্তি সারা দুনিয়া জুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ নাগাদ মিশরে, মেসোপটেমিয়ায়, চীনে এবং ভারতে এদের অস্তিত্ব দেখা যায়। প্রাচীন ভারতে নানা গানে ঘোড়া বলির উল্লেখ আছে। অশ্বমেধযজ্ঞর কথা তো সুবিদিত।
আর্যদের পর এল অশ্বারোহী যোদ্ধাদের দ্বিতীয় তরঙ্গ। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ নাগাদ গ্রিকরা, এরাই যবন নামে অভিহিত। এর পর খ্রিস্টপূর্ব ১০০ নাগাদ শক, হুন, পল্লব (পার্থিয়ান), কুষাণ (মধ্য এশীয় চৈনিক)। সবার শেষে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ হূনরা। এইসব অশ্বারোহীদের চিত্র আমরা পাই সাঁচি আর ভারহুত স্তূপে। অশ্বারোহীর পা-রাখার রেকাব বা পা-দানের উদ্ভাবন ভারতেই হয়েছিল। হুনরা আসার পর এল জিন। এইসব প্রযুক্তি অশ্বারোহণকে স্বচ্ছন্দ করে তুলল। অবশেষে রাজস্থান, গুজরাত, পাঞ্জাব, বিন্ধ্যপ্রদেশ, লাদাখ প্রভৃতি অঞ্চলে অশ্ব-প্রজনন শুরু হল ১০০০ খ্রিস্টাব্দের পরে।
অশ্ব-প্রজননকারীদের তৃতীয় প্রবাহটি এল ইসলামের সঙ্গে। সেই সঙ্গে এল এক নতুন প্রযুক্তি – লোহার রেকাব বা পাদানি আর কাঠের জিন। এর দৌলতে যুদ্ধে অশ্বারোহী তিরন্দাজ সৈন্য দুর্ধর্ষ হয়ে উঠল।
অশ্ব-প্রযুক্তির যুগান্তকারী উদ্ভাবনটা অবশ্য হয়েছিল চীনে। চীনের প্রযুক্তিবিদরা লাগাম পরানোর কায়দা এমনভাবে বদলে দেন যে ঘোড়ার বুকের ওপর চাপ পড়ল না, ঘোড়া অনেক বেশি কাজ করতে পারল। বিশ্ব অর্থনীতিতে, যুদ্ধে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ল। তার সাক্ষী আজকের অশ্বশক্তি পরিভাষা। বিজ্ঞান কীভাবে ইতিহাসের জট ছাড়ায়, অশ্ব-প্রযুক্তির ইতিহাস তার উদাহরণ।