অসম্পূর্ণ বলেই সুন্দর

অসম্পূর্ণ বলেই সুন্দর

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৭ নভেম্বর, ২০২৫

প্রকৃতির বুকে প্রতিটি প্রাণীই যেন এক একটা জীবন্ত চিত্রকর্ম । সে বাঘের ডোরাকাটা দাগ বা চিতাবাঘের ছোপই হোক কিংবা মাছের জটিল রঙের নকশাই হোক – সবই একেকটি বিস্ময়। কিন্তু কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায় যে, এই সৌন্দর্য নিখুঁত নয়। কোথাও রেখা বেঁকে গেছে, কোথাও ছোপ অসম। এই সামান্য ত্রুটিগুলোর মধ্যেই বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন প্রকৃতির সৃজনশীলতার রহস্য।
আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো বোল্ডারের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, এই সূক্ষ্ম অপূর্ণতাই জীবনের বৈচিত্র্য তৈরি করে। এ আসলে এক মহাজাগতিক জৈব-গাণিতিক নকশা। গবেষণা থেকে জানা যায় এইসব সামান্য সামান্য ত্রুটিই কোষগুলোকে এমনভাবে সাজায়, যাতে জীবের শরীর হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যময়, জটিল ও সুন্দর।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই নিয়ম বুঝে যদি মানুষ নতুন উপাদান তৈরি করে, তবে ভবিষ্যতের কাপড় বা যন্ত্র নিজে থেকেই পরিবেশ বুঝে রঙ বদলাতে, নরম হতে বা শক্ত হয়ে উঠতে পারবে, ওষুধ নির্দিষ্ট কোষকলায় পৌঁছে যাবে।
১৯৫০-এর দশকে বিখ্যাত গণিতবিদ অ্যালান টুরিং বলেছিলেন—জীবদেহে রাসায়নিক পদার্থের পারস্পরিক বিক্রিয়ায় তৈরি হয় বিভিন্ন আকৃতির দাগ-ছোপ ও রঙিন নকশা।
কিন্তু বিজ্ঞান যত উন্নত হলো, দেখা গেল বাস্তব প্রাণীর দাগ টুরিংয়ের তত্ত্বের চেয়েও অনেক সূক্ষ্ম ও অদ্ভুতভাবে অসম। প্রকৃতির দাগ যেন কোনো গাণিতিক সমীকরণ মানেই না। বিজ্ঞানীরা বুঝলেন, কেবল রাসায়নিক বিক্রিয়াই নয়, পদার্থবিজ্ঞানের বল, কণার গতি, এমনকি কোষের আকার ও পারস্পরিক সংঘর্ষও এই নকশা তৈরির পিছনে কাজ করে।
গবেষক অঙ্কুর গুপ্ত ২০২৩ সালে টুরিং তত্ত্বে এক নতুন ধারণা যোগ করেন। তার নাম “ডিফিউসিওফোরেসিস”। বিষয়টি হল, যখন কোনো তরলে দ্রবীভূত পদার্থের ঘনত্ব এক জায়গায় বেশি আর অন্য জায়গায় কম থাকে, তখন সেই ঘনত্বের পার্থক্যের ফলে ক্ষুদ্র কণাগুলো নিজে থেকেই এক দিক থেকে অন্য দিকে সরে যায় – কোনো বাইরের বল বা শক্তি ছাড়াই। অর্থাৎ একদল চলমান কণা অন্য কণাদের টেনে নেয়, যেমন কাপড় কাচার সাবান কাপড়ের ময়লা টেনে নিয়ে দাগ হালকা করে।
তারা এ তত্ত্ব প্রয়োগ করেন উজ্জ্বল রঙের বক্সফিশ নামের এক মাছের ত্বকের ওপর। কম্পিউটার মডেলে প্রথমে সব দাগ একেবারে নিখুঁতভাবে তৈরি হল, কিন্তু বাস্তব মাছের মতো প্রাণবন্ত হল না। এরপর গবেষকরা কোষগুলোর আকার ও গতি বদলে দিলেন। তখনই আশ্চর্যজনকভাবে ছবিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠল। কোথাও দাগ মোটা, কোথাও সরু, কোথাও ফেটে ফেটে গেছে। এই সামান্য অসমতা বাস্তব প্রাণীর মতোই স্বাভাবিক সৌন্দর্য এনে দিল।
গবেষক গুপ্ত বলেন, “প্রকৃতিতে নিখুঁত কিছু নেই। এই অসম্পূর্ণতাই সৌন্দর্যের প্রাণ।”
তাঁর গবেষণা শুধু জীববিজ্ঞানে নয়, উপাদানবিজ্ঞানেও বিপ্লব আনতে চলেছে। হয়তো ভবিষ্যতের কাপড় এমনভাবে তৈরি হতে পারে যা নিজে থেকেই রঙ বা নমনীয়তা বদলাবে, কিংবা চিকিৎসা ক্ষেত্রে এমন ক্ষুদ্র কণা বানানো সম্ভব হবে যা একেবারে নির্দিষ্ট কোষে গিয়ে ওষুধ পৌঁছে দেবে। প্রকৃতির ছোটোখাটো ভুল আমাদের শেখায় কিভাবে উন্নত উপাদান তৈরি করতে হয়। আর সেটা এমনই উপাদান যা নিজে থেকে শেখে, মানিয়ে নেয়, ও অভিযোজিত হয়।
আবার, একটি জেব্রার অসম ডোরা কাটা দাগ তাকে ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে রাখে, প্রজাপতির অসম পাখা শিকারিকে বিভ্রান্ত করে। অপূর্ণতা আসলে টিকে থাকার কৌশলও বটে।
প্রকৃতি কখনো সোজা পথে চলে না। তার শক্তি, তার সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে সেই সামান্য বিশৃঙ্খলায়। প্রকৃতির ত্রুটিই তার সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত নকশা। তাই নিখুঁত সত্তার পেছনে ছোটা বন্ধ করে, যদি আমরা প্রকৃতির মতো অপূর্ণতাকে আলিঙ্গন করি, তাহলে হয়তো মানবসভ্যতার প্রযুক্তিও নিঃসন্দেহে একদিন প্রকৃতির মতোই জীবন্ত, পরিবর্তনশীল ও অপূর্ণঅথচ অনন্য সুন্দর হয়ে উঠবে।

সূত্র: Imperfect Turing patterns: Diffusiophoretic assembly of hard spheres via reaction-diffusion instabilities by Siamak Mirfendereski, Ankur Gupta,et.al; published in the journal Matter,(27.10.2025).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

8 − five =