আত্মহননের যুদ্ধ

আত্মহননের যুদ্ধ

ডা: রমেশ চন্দ্র বেরা
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী
Posted on ১ নভেম্বর, ২০২৫

আত্মহত্যার আগে প্রত্যেক আত্মঘাতী বহুদিন ধরে নিজের দেহ ও মনের মধ্যে নিঃসঙ্গ, নিভৃত এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।আত্মঘাতী মন ধীরেধীরে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে, সমাজ ও নিকটজনদের চোখের আড়ালে নীরব সংগ্রামে চালায়।

 

এই যুদ্ধ কারো চোখে পড়ে না বা ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে জানতে দেয়না, জানাতে চাইলেও সুকৌশলে তা ধামাচাপা দেয়। আত্মহননেচ্ছু মানুষটি হয়তো হাসছে, কাজ করছে, কথা বলছে— কিন্তু তার মনের গভীরে এক গোপন আগ্নেয়গিরি ধীরেধীরে বারুদ (অভিমান, রাগ, বিদ্বেষ, অসহ্য কষ্ট-যন্ত্রণার) সঞ্চয় করছে। ভালো কিছু ভাবা বা ভালো কিছু করার অভিলাষটা এই যুদ্ধে একটু একটু করে পরাজয়ের পথে অগ্রসর হয়। কারণ এইসব মানুষ স্ব-মূল্যায়ন করে না , আস্থা হারায় সবকিছুতেই। সে ভাবে , তার সবকিছু শেষ , তাকে দিয়ে আর কিছু হবে না। সামনের দিনগুলোও যে আলোকিত হতেপারে, ধীরেধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে- তা ভেবে দেখে না সে। সে কেবল “করবো রে, মরবো রে, জয় করবো রে”—এই মনোবলে যেন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। কোনো এক সময় সেই আগ্নেয়গিরিকে অজানা কারণ এসে উদ্দীপিত করে আর সব টানাপোড়েনের সমাপ্তি ঘটে। প্রতিদিন পৃথিবীর কোথাও না কোথাও হাজার হাজার পুরুষ ও নারী একা অথবা সম্মিলিতভাবে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন।

একটি তথ্যভিত্তিক পরিসংখ্যান বলছে—১০০ জন আত্মঘাতী মহিলার মধ্যে ৯০ জন আত্মহননে ব্যর্থ হন, কিন্তু ১০০ জন পুরুষের মধ্যে ৯০ জনই আত্মহননে সফল হন। কথায় আছে, “মরদ কি বাত, হাতি কা দাঁত ।” একবার সিদ্ধান্ত নিলে তারা তা বাস্তবায়ন করতে পিছপা হয় না। সে সিদ্ধান্ত হয়তো অনুচ্চারিত, অথচ ভীষণভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ভীষ্মের প্রতিজ্ঞার মতো, সেই সংকল্প থেকে পিছু হঠে না। জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত পালন করে।

 

আত্মহনন এক অভিশাপ

 

আই আই টি খড়গপুরে ২০২৫ সালে বেশ কয়েকজন ছাত্র আত্মহত্যা করেছে। তারা সকলেই মানসিকভাবে পরাজিত, অথচ মেধাবী ও সম্ভাবনাময় তরুণ। এই দুঃখজনক ঘটনা গোটা সমাজকে নাড়া দিয়েছে।

শুধু ছাত্র নয়—আইনজীবী, পুলিশ, ডাক্তার, বৃদ্ধ ও কিশোর—সবার মধ্যেই আজ আত্মহননের প্রবণতা বেড়েছে। এ প্রবণতা যেমন আত্মবিনাশী, তেমনি এক ধরনের অসামাজিক ব্যাধি।

কীভাবে এই কঠিন মানসিক ব্যাধি থেকে আমাদের অমূল্য মানবজীবনকে রক্ষা করা যায়? আজ যদি আমরা সতর্ক না হই, তবে ভবিষ্যতে আমাদের সন্তান-সন্ততির মৃত্যুতে শোকার্ত পরিবার, পিতামাতা, স্বামী বা স্ত্রীদের সামনে কী উত্তর দেব?

আত্মহননের মতো কাপুরুষোচিত, ঘৃণ্য, কুৎসিত অপরাধ আর কিছু নেই। এ এক নীরব আত্মসমর্পণ, যা সমাজ ও মানবতার পরাজয়। আত্মহননেচ্ছুর যুদ্ধ হয় তার নিজের মধ্যেই—মন, দেহএবং ‘আমি’-রমাঝে। এ যুদ্ধ চলে নিঃশব্দে, কখনো বা বহু বছরধরে। দেহ এক যুদ্ধক্ষেত্র, মন ও ‘আমি’ তার দুই যোদ্ধা। তবু কেউ জানে না, কখন এই যুদ্ধের পরিণামে সেই মানুষটি নিজেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। অনেকসময় শুধু ঘনিষ্ঠ জনেই টের পান, ছোট ছোট পরিবর্তনের মাধ্যমে। কিন্তু তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে।

বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর আটকোটিরও বেশি মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে এই হার খুব বেশি। ভারতে প্রতি লক্ষে ১৪জন, বাংলাদেশে ৮জন, শ্রীলঙ্কায় ৬ জন, থাইল্যান্ডে ৫জন আত্মহত্যা করেন (২০১৬ সালের পরিসংখ্যান)। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এই হার প্রতি লক্ষে ২০জন, স্পেনে ৯ জন এবং হাঙ্গেরিতে প্রতি লক্ষে ৫৮জনেরও বেশি।

 

আত্মহত্যার অন্যতমকারণ মানসিক অবসাদ। এছাড়াও, ক্যান্সার, এইডস, বা অন্যান্য দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত অনেকেই জীবনকে আর টানতে চান না।

আরওএকটিগুরুত্বপূর্ণকারণ—একাকিত্ব।

বয়স বাড়ে, বন্ধুবান্ধব হারিয়ে যায়, একাকিত্ব ঘিরে ধরে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। অবহেলা, দায়িত্বহীনতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং মানসিক নিঃসঙ্গতা—র সবই একাকী মানুষকে ধীরেধীরে এই পথের দিকে ঠেলে দেয়।

 

আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়।এ এক অন্ধকার গহ্বর, যেখানে ঢুকে পড়লে আর ফেরার পথ থাকে না। যারা জীবন নিয়ে ক্লান্ত, তারা যেন জানে—তাদের পাশে কেউ না কেউ আছে। কথা বলুন, সাহায্য চান, সাহায্য করুন। জীবন অনেক বড়, অনেক সম্ভাবনাময়।

জীবনকেভালোবাসুন।জীবনকেবাঁচান।

 

মানবজীবনেরধাপ

 

প্রথম অধ্যায়: শৈশব থেকেই যুদ্ধের পাঠ

মানুষের

জীবন শুরু হয় যুদ্ধশিক্ষার মধ্য দিয়ে—অন্তত মানসিকভাবে। আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মধ্যে শ্রবণেন্দ্রিয় প্রথম সক্রিয় হয়। মাতৃগর্ভে শেষ তিনমাসে ভ্রূণ যখন আধা-সচেতন অবস্থায় থাকে, তখনই সে শব্দ শুনতে শুরু করে।

জন্মের পর শিশুর প্রথম শব্দ—”ওঁয়াওঁয়া”—তার প্রথম যোগাযোগ। কিছুদিনের মধ্যেই সে পিতামাতার কণ্ঠস্বর চিনতে শেখে, আধো আধো কলকাকলি শুরু হয় তিন মাসে। এরপর আসে মা-মা, বা-বা— ‘মা’ প্রথমে, ‘বাবা’ পরে। এই শব্দ ও অনুভূতিরাশি শিশুর মনে গেঁথে যায়; জ্ঞানের শিকড় প্রোথিত হয়।

ছোট্ট শিশুটি জন্মের একবছর পর্যন্ত অপরিচিত লোকের কোলে চলে যেতে পারে নির্বিঘ্নে। কিন্তু একবছর পর সে অপরিচিতদের এড়াতে শেখে, কাঁদে, চিৎকার করে—এটিই তার আত্মরক্ষার সূচনা।

এই সময়ে ইন্দ্রিয় ও পরিবেশের সংস্পর্শে শিশুর মন দ্রুত গঠিত হয়। শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ প্রায় সম্পূর্ণ হয় আটবছর বয়সে। তখন তার ভবিষ্যৎ চরিত্র ও মানসিকতা অনেকটা নির্ধারিত হয়ে যায়।

তাই শৈশবেই শেখানো উচিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বোধ—

1. আত্মহত্যা মহাপাপ।

2. অপরিচিতকে চিনে সচেতনহওয়া।

3. নিজের সীমা ও শক্তিজানা।

4. প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম।

5. বিপদে পালাতে শেখাও আত্মরক্ষা।

ইংরেজিতে একে বলে—Fight, Flight, or Fright।জীবন বাঁচানোই প্রাথমিক কর্তব্য।

 

দ্বিতীয়অধ্যায়: বয়ঃসন্ধির দ্বন্দ্ব

 

বয়ঃসন্ধি এক জটিল, দ্বন্দ্বময় সময়কাল। মনোরোগবিশেষজ্ঞদের মতে, এই সময়সীমা কেউ বলেন ১০–১৯ বছর, কেউ বলেন১৫–২৪বছর। WHO এবং জাতীয় নীতিমালায় ১০–২৪ বছরের ছেলেমেয়েদেরই “কিশোর-যুবা” ধরা হয়।

এই সময় শরীর যেমন পরিবর্তিতহয়, তেমনি প্রয়োজন মানসিক ও সামাজিক বিকাশের। কিন্তু আজকের মিডিয়া-নির্ভর সমাজে ছেলেমেয়েরা প্রজননসক্ষমতা অর্জন করলেও মানসিক বিকাশে পিছিয়ে। ফলে বাড়ছে নাবালিকার মা হওয়া, বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ, আর আত্মহত্যা নামক অমানবিক ঘটনার সংখ্যাও।

আইন মেয়েদের ১৮ ও ছেলেদের ২১ বছর বয়সে বিয়ের অনুমতি দিলেও, সমাজ সেই আইন মানছে না।

 

তৃতীয় অধ্যায়: মোবাইল সিন্ড্রোম — এক নতুন ব্যাধি

 

মোবাইল স্ক্রিনের আলো মস্তিষ্কে সেরোটোনিন ও ডোপামিন হরমোন বাড়িয়ে তোলে, যা আমাদের জেগে থাকতে সাহায্য করে। কিন্তু রাতে প্রয়োজনীয় ঘুমের হরমোন মেলাটোনিন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে ঘুম আসে না।

একটানা মোবাইল ব্যবহারে এই হরমোন ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। যদি রাতেই ফোন বন্ধ করা হয়, তবে অন্তত একঘণ্টা পরে ঘুম আসতে পারে, কিন্তু মধুর স্বপ্নবিহীন বিশ্রাম পেতে আরও সময় লাগে। বহু রোগীই মোবাইল আসক্তিতে ভোগেন।

 

 

মানসিক যুদ্ধে হেরে যাওয়া মানুষদের জন্য প্রয়োজন কাউন্সেলিং, বিশেষজ্ঞের সহায়তা, এবং আশেপাশের মানুষের মানসিক সমর্থন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × two =