আদর্শ স্ট্যালাগমাইট আকৃতির মৌলিক নিয়ম 

আদর্শ স্ট্যালাগমাইট আকৃতির মৌলিক নিয়ম 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৮ নভেম্বর, ২০২৫

চুনাপাথরের কার্স্ট গুহার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা স্ট্যালাগমাইটের পাথুরে স্তম্ভগুলোকে অনেকেই শুধুমাত্র ভূতাত্ত্বিক সৌন্দর্যের নিদর্শন বলে মনে করেন। কিন্তু সম্প্রতি পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও স্লোভেনিয়ার গবেষকদের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত একটি গবেষণা জানাচ্ছে, এসব স্তম্ভ আসলে প্রকৃতির অত্যন্ত সূক্ষ্ম এক ‘গাণিতিক স্বাক্ষর ’। বাহ্যিক বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীর প্রায় সব স্ট্যালাগমাইটই গঠিত হয় মাত্র একটি মৌলিক নিয়মের অধীনে। সেটি হল একটি সংখ্যা, যার নাম ড্যামকোহলার সংখ্যা।

এই সংখ্যা আসলে জলের প্রবাহ ও ক্যালসিয়াম কার্বনেট নামক খনিজের জমাট বাঁধার গতির অনুপাত। আর সেই অনুপাতই নির্ধারণ করে কোন ধরনের স্ট্যালাগমাইট তৈরি হবে: সরু শঙ্কু, মোটা স্তম্ভ, নাকি সম-শীর্ষ কোনো চ্যাপ্টা আকৃতি। অর্থাৎ গুহার ছাদ থেকে পড়তে থাকা জলের ফোঁটার গতি, তার ছড়িয়ে পড়া, এমনকি বাতাসে তার সামান্য ঘূর্ণন—সব মিলিয়েই ঠিক হয় খনিজ পদার্থ কোথায় জমা হবে, আর সেখান থেকেই নির্ধারিত হয় স্ট্যালাগমাইটের চূড়ান্ত রূপ।

ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী পিওতর শিমচাকের নেতৃত্বে গবেষকরা প্রথমে এক বিশ্লেষণধর্মী মডেল তৈরি করেন। সে মডেলে তাঁরা স্ট্যালাগমাইটের ‘আদর্শ’ সম্ভাব্য রূপগুলির গণিতিক সমীকরণ বের করেন।এরপর স্লোভেনিয়ার বিখ্যাত পোস্টোজনা গুহা থেকে সংগৃহীত নমুনার এক্স-রে স্ক্যানের সঙ্গে সেই গণনা মেলান। আশ্চর্যের ব্যাপার, তাত্ত্বিক মডেল বাস্তব নমুনার সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে গেল।

অর্থাৎ, গুহার ভেতরর নিস্তব্ধ পরিবেশে, অন্ধকারের মাঝে হাজারো বছর ধরে প্রকৃতি এই সরল সূত্র অনুযায়ী একইভাবে শিল্পকর্ম সৃষ্টি করে চলেছে।

গবেষকরা ভিন্ন আকৃতি গঠনের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন —যদি জলবিন্দু খুব দ্রুত ও কেন্দ্রীভূতভাবে পড়ে, তবে উপরের শীর্ষে বেশি খনিজ জমা হয়ে স্ট্যালাগমাইট সরু শঙ্কুর মতো হয়। যদি ধীরে কিন্তু এক জায়গায় স্থিরভাবে পড়ে, তখন চওড়া ও মোটা একটি স্তম্ভ তৈরি হয়। আর যদি গুহার ছাদ অনেক উঁচু হয় এবং জলবিন্দু পড়ে ছড়িয়ে যায় বা সামান্য ঘোরে, তখন উপরের অংশ চ্যাপ্টা হয়ে যায়, যেটা বড় গুহার কক্ষগুলোর পরিচিত দৃশ্য। তাঁরা আরও জানান, জলবিন্দু কখনোই পুরোপুরি সোজা পথে পড়ে না। বাতাসের গতি ও ঘূর্ননের প্রভাবে সেগুলো কয়েক ইঞ্চি পর্যন্ত সরে যেতে পারে। আবার উচ্চতা বেশি হলে ফোঁটা পড়ে চারদিকে ছিটকে যায়, ফলে স্ট্যালাগমাইটের উপরে একটি সমতল অংশ তৈরি হয়।

স্ট্যালাগমাইট শুধু গুহার সৌন্দর্য নয়, প্রাকৃতিক জলবায়ুর সংরক্ষণমূলক তথ্য হিসেবেও পরিচিত। এর প্রতিটি স্তরে সংরক্ষিত থাকে অতীতের তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের চিহ্ন। নতুন গবেষণা জানাচ্ছে, এই স্তম্ভগুলোর আকৃতিও সেই সংকেতকে প্রভাবিত করতে পারে। যেমন, চ্যাপ্টা শীর্ষে আইসোটোপের পরিবর্তন সমান থাকে, আর শঙ্কু বা স্তম্ভাকার গঠনে কেন্দ্র থেকে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে; ফলে এদের আকৃতি অনুধাবন করে আরও নিখুঁত জলবায়ু বিশ্লেষণ সম্ভব।

সবশেষে গবেষকদের মতে, গুহাগুলো যতই জটিল ও বৈচিত্র্যময় হোক, তাদের পাথুরে স্মৃতির ভেতরে একটিই সহজ সূত্র লুকিয়ে আছে। ড্যামকোহলার নামের সেই সংখ্যা স্ট্যালাগমাইটের আকৃতি, গঠনের গতি এমনকি প্রাচীন জলবায়ুর ইঙ্গিত ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে, যা ভবিষ্যতের গবেষণাকে আরও নির্ভুল করবে।

 

সূত্র: Shapes of ideal stalagmites by Piotr Szymczak, Anthony J. C. Ladd , et.al; published in Proceedings of the National Academy of Sciences , 16th October,2025.

https://doi.org/10.1073/pnas.2513263122

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × 2 =