
ব্যাকটেরিয়া আর এক-কোষী আর্কিয়া – প্রাণের এই দুই রূপের মাঝখানে আছে এক জীব যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘শেষ সর্বজনীন অভিন্ন পূর্বপ্রজন্ম’ (লাস্ট ইউনিভার্সাল কমন অ্যানসেস্টর), সংক্ষেপে ‘শেষঅপূ’। । ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ এডমান্ড মুডির গবেষক দল হাজার জিনোম ছেঁকে দেখতে চেয়েছেন এই অভিন্নতার পথ ধরে কতটা পিছনে হাঁটা সম্ভব। শেষঅপূর বৈশিষ্ট্য কী-কী তা নির্ণয় করতে গিয়ে তাঁরা মোটের ওপর ২৬০০টি জিনের ওপর ভরসা রাখছেন। সাদামাটা একটা ব্যাকটেরিয়ামও প্রায় অতগুলি জিনই বহন করে। এই ২৬০০টি নকশার ভিতরে আছে ঝিল্লি পাম্প, ডি এন এ মেরামতের উপকরণ আর সরল লিপিডের যাবতীয় উপাদান। এর মধ্যে আছে এক ছিমছাম রাসায়নিক গ্রন্থি যা কার্বন ডাই অক্সাইড আর হাইড্রোজেনকে জোড়া লাগিয়ে দেয়, যা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে অ্যাসিটেট, আর সব মিলিয়ে পাওয়া যায় ব্যবহারযোগ্য শক্তি।
এতসব ব্যবস্থা থাকার অর্থ, এটি একটি স্বাবলম্বী কোষ, বাইরের কোনো সাহায্য ছাড়াই বেঁচেবর্তে থাকতে পারে। কিন্তু এতদিন মনে করা হত, আদিম প্রাণ যেন ভূতত্ত্বের লেজুড় ধরেই জটিলতা অভিমুখে রওনা দিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, পৃথিবী গ্রহ জল ধরে রাখার মতো শীতল হওয়া মাত্রই এই শেষঅপূ নিজেই অভিযোজন মারফত নতুন নতুন কায়দা বার করতে পেরেছিল। পৃথিবীর এতদিনকালের ইতিহাসে সমস্ত জিন-পরিবর্তনের ইতিহাস অনুসরণ করে এই গবেষকরা নির্ণয় করেছেন, শেষঅপূর আবির্ভাব আজ থেকে ৪২০ কোটি বছর আগে। তার মানে পৃথিবী গ্রহর আবির্ভাবের মাত্র কয়েকশো মিলিয়ন বছর পর। আরেকজন গবেষক ডঃ স্যান্ড্রা আলভারেজ-কারেতেরো বলেছেন, “আমরা ভাবতে পারিনি যে শেষঅপূর বয়স এতটা বেশি’। তবে তাঁদের এই গবেষণার ফল কিন্তু আদি বসুন্ধরার বাসযোগ্যতা সংক্রান্ত আধুনিক ধ্যানধারণার সঙ্গে মিলে যায়। সেই কালে গ্রহাণুর ধাক্কা আর আগুন-উগরোনো আগ্নেয়গিরিগুলো ভূত্বককে কেবলই খাড়া করে তুলছিল। অথচ সমুদ্রতলের রন্ধ্রগুলি থেকে খুব সম্ভব বেরিয়ে আসছিল উষ্ণ এবং ধাতু-সমৃদ্ধ মরীচিকা। লোহা, নিকেল আর সালফারের আকরিকগুলো খব সম্ভব শেষঅপূ-র জিনোমের বিক্রিয়াগুলির চিত্রনাট্য রচনা করছিল। গবেষক অধ্যাপক দাভিদ পিসানি জানান, “আমাদের গবেষণা জানাচ্ছে যে এই শেষঅপূ ছিল একটি জটিল জীব। আধুনিক অ-কেন্দ্রক কোষগুলির থেকে তারা খুব একটা আলাদা ছিল না। কিন্তু তখনই তার ছিল এক আদি রোগ-প্রতিরোধ তন্ত্র। তখনই তারা ভাইরাসদের সঙ্গে এক অস্ত্র-প্রতিযোগিতায় মেতেছিল”। খুব সম্ভব কোষের আবির্ভাবের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শিকারী ভাইরাসরা আবির্ভূত হয়েছিল। জিনের রদবদলের পিছনে ভাইরাস-হানার ভূমিকা ছিল। সংক্রমণ ঠেকানোর তাড়ায় জীবাণুরা নতুন নতুন উৎসেচক, নতুন নতুন পথরেখা, এমনকি একেবারে আগাপাশতলা নতুন বিপাকীয় জীবনধারাও উদ্ভাবন করে থাকতে পারে। পরের প্রজন্ম সেগুলোর উত্তরাধিকারী হয়।
সংক্ষেপে, মহাসাগরের কাদামাটি কিংবা মরুভূমির উপরিত্বক থেকে টেনে-আনা প্রতিটি জিনোমকে জোড়া লাগিয়ে লাগিয়েই এই শেষঅপূর চেহারাটা ফুটে উঠবে। সুপ্রাচীন কালের নির্মাণ-নকশা আরও পরিশীলিত হচ্ছে। ভূতত্ত্ব আর জিনতত্ত্বর মধ্যে বন্ধন দৃঢ়তর হচ্ছে। এই গবেষণার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন পত্রিকায়।