আমাদের এই জটিল সমাজকাঠামোয় মানুষের মুখ চিনতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, এবং ভাবা হত যে, এই কাজের জন্য মানুষের মস্তিস্কের মতো উন্নত ব্যবস্থা হয়তো আবশ্যিক। কিন্তু ‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন সাইকোলজি’ পত্রিকায় প্রকাশিত নতুন গবেষণা জানাচ্ছে, মৌমাছি বা বোলতা প্রজাতির পতঙ্গের ক্ষেত্রেও মুখ চেনার পদ্ধতি মানুষের মতোই।
অথচ পতঙ্গের মাথায় যেখানে এক মিলিয়নের কম কোষ থাকে, সেখানে মানুষের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ছিয়াশি হাজার মিলিয়ন। ঠিক কোন আয়তনের মগজ হলে এইধরণের জটিল কাজ করা সম্ভব তা অবশ্যই ভাববার বিষয়, এখান থেকেই উঠে আসে কীভাবে মনুষ্যপ্রজাতি এই উন্নত মস্তিস্কের অধিকারী হল বিবর্তনের যাত্রাপথে সেই ব্যাখ্যাও।
অনায়াস কিন্তু জটিলঃ
রেলষ্টেশনের মতো ভিড়ভাট্টার জায়গায় হাজার মানুষের মধ্যে আমরা চেনা মুখটা ঠিক খুঁজে পেয়ে যাই যে অদ্ভুত দক্ষতায় তা আমাদের কাছে আয়াসহীন অথচ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের দ্বারা সে কাজ সম্ভব হয়ে ওঠে না অনেকসময়েই। মুখ চেনার এই পদ্ধতি মানুষের ক্ষেত্রে একপ্রকারের ‘হলিস্টিক প্রোসেসিং’-এর মাধ্যমে হয়ে থাকে, মুখের বিভিন্ন অংশের গঠনগত তথ্য আমাদের মগজের জমা হয়ে এমন উন্নত নিরীক্ষণ তৈরিতে সক্ষম। চোখ, নাক, ঠোঁট, কান ইত্যাদি ভিন্ন বৈচিত্র্য মাথার ভেতরে একইসাথে ‘একক’ হিসেবে তথ্য তৈরি ক’রে রাখে, এভাবেই আমরা ব্যক্তিতে চিহ্নিত করতে পারি।
অন্যান্য প্রাণী কীভাবে মুখ চিনতে পারে, তা নিয়ে গবেষণার আগ্রহ দীর্ঘদিনের।
পতঙ্গের ব্যাপারস্যাপারঃ
পতঙ্গদের দৃষ্টিক্ষমতার পরীক্ষার জন্য মৌমাছি খুব সহজেই পাওয়া যায়। একেকটা মৌমাছিকে তো মিষ্টিদ্রব্যের পুরস্কার দিয়ে জটিল প্রক্রিয়াতে সামিল করানো যায়। বোলতাকে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার উপায়ও ইদানিং খুঁজে পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মানুষের মুখ চেনার পদ্ধতি মৌমাছি ও বোলতাদের শেখানো যায়। পতঙ্গদের ক্ষেত্রে মুখ চেনার ব্যাপারটা কী সরল, নাকি তা মানুষের মতোই জটিল কোনও গঠনের ফলাফল – গবেষণার উপজীব্য এটাই।
পরীক্ষাপদ্ধতিঃ
সাধারণত দুটি পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয় – Part-whole Effect এবং Composite-face Effect; পার্টহোল এফেক্টে যেখানে আলাদা আলাদা ক’রে মুখের বিভিন্ন অংশের গঠনের মধ্যে প্রভেদ করা যায়, সেখানে কম্পোসিট-ফেস এফেক্টে মুখের বাইরের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নাক-চোখ-ঠোঁট পৃথকীকরণ করার চেষ্টা করা হয়। প্রথম পদ্ধতিতে খুব সহজেই সম্পূর্ণ মুখমণ্ডলের সাপেক্ষে মুখের আলাদা বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব, আর দ্বিতীয়টিতে অনেকসময়ই ভুল ফলাফল আসে। মানুষের ক্ষেত্রে তার উন্নত মস্তিস্কের জন্য, মুখের বিভিন্ন চরিত্র একসাথে স্মৃতিতে কাজ ক’রে নিখুঁতভাবে চিনতে সাহায্য করে একটি বিশেষ মুখ।
পরীক্ষায় যা উঠে এলোঃ
মৌমাছি ও বোলতাদের উপর যখন এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হল, দেখা যাচ্ছে তারা মানুষের মুখের সাদা-কালো ছবি মনে রাখতে পারছে। পাশাপাশি তাদের আরও কয়েকটা পরীক্ষাতেও ফেলা হয়। ফলাফল বলছে, মানুষের মুখ চিনে রাখার বিবর্তন-ঘটিত কোনোরকম কারণ না-থাকলেও, পতঙ্গের মগজে জটিল ছবিগুলিও ‘হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ’-এর মাধ্যমেই জমা হতে থাকে। মুখাবয়বের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে জুড়েই তারা বিশেষ মানুষের মুখ সম্পূর্ণভাবে মনে রাখতে পারে। অর্থাৎ, জানা গেলো এই যে, পতঙ্গের ঐ ক্ষুদ্র মাথাতেও অন্তত কয়েকটি মুখ মনে রাখার মতো ব্যবস্থা আছে। মানুষের বৃহদাকার মগজ অতএব একসঙ্গে অগুনতি মুখ মনে রাখতে পারে।
অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে জটিল ছবি নিয়ে একইধরণের পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে হয়তো একদিন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ক্ষেত্রেও মানুষের মুখ চিনতে পারার বাঁধাটুকু অতিক্রম ক’রে ফেলবে আধুনিক বিজ্ঞান।