আমাদের স্বাস্থ্য , অসুখবিসুখ এবং ডারউইনের তত্ত্ব

আমাদের স্বাস্থ্য , অসুখবিসুখ এবং ডারউইনের তত্ত্ব

Posted on ৮ এপ্রিল, ২০১৯

“Nothing in Biology makes sense except in the light of evolution”
– Theodosius Dobzhansky

প্রবাদপ্রতিম জীববিজ্ঞানীর উপরের কথা’টা শিরোধার্য ক’রে যদি শুরু করি, তাহলে প্রথমেই থমকে দাঁড়াতে হয়। আমরা কি প্রাণীজগতের বাইরে? নাকি, চিকিৎসাবিজ্ঞান আদতেই জীবনবিজ্ঞানের বাইরে স্বয়ম্ভূ ভুঁইফোড় গোছের কিছু? কেননা, সত্যিই, জীববিদ্যার বাকি-সব শাখায় বহুল প্রয়োগ সত্ত্বেও, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে, বা বলা ভালো আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মূলস্রোতে, ডারউইনের বিবর্তনের তত্ত্বের তেমন ব্যবহার কতটুকু?

কিন্তু, ব্যবহার তেমনভাবে হয়ে ওঠেনি – মানে কি চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিবর্তনবাদের প্রাসঙ্গিকতা’ও নেই? নাকি, ব্যাপারটা এমন যে, বিবর্তনের তত্ত্বের প্রয়োগ চিকিৎসাকে করতে পারত আরও নিখুঁত, আরও যথাযথ, অথচ কোনো অনিবার্য কারণে তেমন’টি হতে পারেনি? চলুন, উত্তর’টা খুঁজেই দেখি।

স্কুলের বইয়ের পাতা থেকে ডারউইন সাহেব’কে হঠাৎ ক’রে সম্প্রতি দেশে প্রচারে এনেছেন এ-দেশের মন্ত্রীমশাই। মন্ত্রীমশাই কঠোর যুক্তিবাদী মানুষ। নিজের চোখে কাউকে বাঁদর থেকে মানুষ হতে দেখতে পাননি ব’লে, একেবারে ডারউইন সাহেবকে’ই উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। ভাগ্যিস দেখতে পাননি। কে’ই বা নিজের দাদু কিম্বা বাবাকে শিম্পাঞ্জি হিসেবে দেখতে ভালোবাসে !

তাঁর সরল চিন্তা্র অপরাধ নেবেন না। মুশকিল হলো, বিবর্তনের তত্ত্বের সময়ের হিসেব’টা একটু গোলমেলে। মন্ত্রীমশাইয়ের হিসেব পাঁচবছরের, মানে পরের নির্বাচন। তোমরা যারা ইশকুলে পড়ছো, আশায় আশায় আছো, কবে পছন্দের কলেজে যেতে পারবে আর বাড়ির শাসনটা কবে একটু আলগা হবে। তোমাদের সময়টা জনপ্রতিনিধির চাইতে বেশি। কিম্বা কর্মরত আপনি হয়তো চেয়ে থাকেন ছেলে বড়ো হয়ে নিজের পায়ে কবে দাঁড়াবে, সেই-দিকে। অর্থাৎ, আপনার হিসেব আরেকটু লম্বা সময়ের। কিন্তু, বিবর্তন বা প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বের ক্ষেত্রে হিসেবটা কয়েক হাজার, কিম্বা লক্ষ বছরের। সেখানে, মনুষ্যজীবনের কয়েক প্রজন্ম তো স্রেফ নস্যি, আমাদের কয়েক সেকেন্ডের সমতুল্য। কাজেই, আমাদের স্বল্প সময়ের হিসেব অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিবর্তনের তত্ত্বের রসাস্বাদনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

তা এই কয়েক হাজার বছরের পথ পেরিয়ে, আমরা আজ যে মানুষ হয়ে উঠলাম, আমাদের শরীরে তার কোনো ছাপ থাকবে না, সেও কি সম্ভব? প্রশ্ন এইটা’ই, আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে, আমাদের স্বাস্থ্যে, কিম্বা অসুস্থতায়, বিবর্তনের সেই চিহ্নগুলোর তাৎপর্য কতটুকু?

ডারউইন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান – নিবিড় যোগাযোগ, নাকি মূলগত দূরত্ব?

চার্লস ডারউইন ছিলেন চিকিৎসক-পরিবারের সন্তান। বাবা-ঠাকুরদা দুজন’ই ছিলেন ডাক্তার। তিনি নিজেও ডাক্তারি পড়া শুরু করেছিলেন, কিন্তু মাঝপথে ছেড়ে দেন। বিবর্তনবাদ কিম্বা প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব যে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তন আনতে পারে, এ নিয়ে তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না।

Bridge over health and disease
সমস্যা হলো অন্যত্র। ডারউইনের কিছু আগেই, লুই পাস্তুরের নেতৃত্বে, অসুখবিসুখের জার্ম-থিয়োরি সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পেলো। আর ডারউইনের কাছাকাছি সময়েই রবার্ট কখ জার্ম-থিয়োরি’কে সূত্রে বেঁধে দৃঢ় বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে স্থাপন করলেন। কাজেই জার্ম-থিয়োরির প্রাতিষ্ঠানিক মান্যতা অর্জনে তেমন বাধা রইল না। এই তত্ত্বের মূলে যে ধারণা, অর্থাৎ, অসুখের কারণ শরীরের বাইরে থেকে আসা আক্রমণ, যাকে উপযুক্ত অস্ত্রের সাহায্যে বশ করা সম্ভব – সেই ধারণা, শিল্পবিপ্লবোত্তর ইউরোপের গণউৎপাদন এবং উদ্বৃত্ত পণ্যের আবহে সহজ জনপ্রিয়তা পেতে থাকল। একেবারে শুরুতেই, পাস্তুরের বিপরীতে গিয়ে আন্তোয়ে বেশঁ বলার চেষ্টা করেছিলেন বটে, যে, সঠিক পরিবেশ না পেলে জীবাণু থাকলেও অসুখ হয় না, কিন্তু সেই-কথা তেমন আমল পেল কই! অথচ, শরীরের ভিতর কিম্বা বাইরে, সুবিধেজনক পরিবেশ না-পেলে যে জীবাণুর উপস্থিতি সত্ত্বেও অসুখবিসুখ হয় না, এ-কথা অনুমান করা তো তেমন কঠিন নয়। আপনার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা যদি ঠিক থাকে, তাহলে আপনি সহজে অসুখে ভুগবেন না। অন্যদিকে, একজন দুর্বল মানুষ সহজেই অসুখবিসুখ বাধিয়ে বসেন। শোনা যায়, একেবারে শেষজীবনে, পাস্তুর নিজেও মেনে নিয়েছিলেন যে, উপযুক্ত পরিবেশ না-পেলে জীবাণুও অসুখের কারণ হতে পারে না, কাজেই শরীরের আভ্যন্তরীণ বা বাইরের পরিবেশটাই আসল কথা, অসুখের কারণ শুধুমাত্র শরীরের বাইরে খোঁজাটা একটা ভুল [পাস্তুর নাকি শেষে বলেছিলেন : Germs are nothing, milieu (কাছাকাছি বাংলা করলে – আভ্যন্তরীণ পরিবেশ) is everything] । কিন্তু, গণউৎপাদনের সেই যুগে, বাইরে থেকে আসা শত্রু আর চটপট ওষুধ খুঁজে তার সমাধান, এই ধারণার সর্বজনগ্রাহ্যতা আটকানোর ক্ষমতা তখন স্বয়ং পাস্তুরেরও আর ছিল না।

তড়িঘড়ি সমাধান খোঁজার সেই-সময়ে, আমাদের অসুখের কারণ অযুতবছর পুরোনো, এমন কথা কারোর’ই মাথায় আসে না, কাজেই ডারউইনের তত্ব চিকিৎসাবিজ্ঞানে তেমনভাবে গৃহীত হলো না। কিন্তু, জীববিদ্যার প্রায় প্রতিটি শাখাতেই, গবেষকেরা এই তত্ত্বের প্রয়োগ শুরু করলেন। এমনকি, আজ থেকে প্রায় একশো বছরেরও বেশি আগে বিবর্তনবাদী জীববিদ্যা (Evolutionary Biology) জীববিদ্যার অন্যতম প্রধান একটি শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিবর্তনবাদী জীববিদ্যা একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ধারা হয়ে উঠলো, কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান রয়ে গেল তার আওতার বাইরে।

জার্ম থিয়োরি – চিকিৎসা জগতে একটি বিপ্লব

জার্ম-থিয়োরি চিকিৎসাভাবনার জগতে একটি বৈপ্লবিক ধারণা। চরক কিম্বা হিপোক্রেটিস, সভ্যতার আদিকাল থেকেই, অসুস্থতার কারণ খুঁজতে আমরা শরীরের বাইরে তাকাইনি। অথবা, যখন রোগের কারণ হিসেবে বহির্জগতকে দায়ী করেছি, তখন মানুষের চিকিৎসা ক’রে বাইরে-থেকে-আসা রোগের নিরাময়ের চেষ্টা করিনি। কিন্তু, জার্ম-থিয়োরির সুবাদে প্রায় সব অসুখের কারণ খোঁজা শুরু হলো শরীরের বাইরে। ব্যাধিকে শরীরের বাইরে অপর হিসেবে ভাবার প্রবণতা, এবং যে-কোনো মূল্যে যে-কোনো অস্ত্রে তাকে ঘায়েল করার চিন্তা, এই তত্ত্বের অনিবার্য অঙ্গ। এই চিকিৎসাদর্শন সুদূরপ্রসারী, সংক্রামক ব্যাধির সীমানা ছাড়িয়ে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতি শাখাতেই এই তত্ত্বের প্রভাব।

Darwin and his probable grandfather – a caricature
কাজেই, চিকিৎসা হয়ে দাঁড়ালো যুদ্ধ – অসুখের বিরুদ্ধে, এমনকি কখনো রোগগ্রস্ত অঙ্গের বিরুদ্ধে। নিত্যনতুন অস্ত্রের সম্ভারে সজ্জিত চিকিৎসক দাঁড়ালেন রোগীর পাশে, উপশম কিম্বা নিরাময় নয়, রোগমুক্ত করার অহংকারে। প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতি, যাঁরা এই ভাবনার সাথে তাল মেলাতে পারলেন না, পর্যবসিত হলেন প্রায় প্রান্তিক উপজাতিতে। আধুনিক চিকিৎসাকেন্দ্র অত্যাধুনিক সমরতরীতে পরিণত হলো।

চিকিৎসা – নিরাময়, নাকি রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ?

রোগের কারণ বাইরে থেকে আসা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জীব, তাকে নিকেশ করতে পারলেই কেল্লা ফতে। কাজেই শত্রুনিধনের এই চিকিৎসাপদ্ধতি’তে উত্তরোত্তর জনপ্রিয় হতে লাগলো সামরিক অনুষঙ্গে ব্যবহৃত শব্দাবলী। গত শতকের একেবারে শুরুতেই পল এলরিখ আনলেন ম্যাজিক বুলেটস, রোগের কারণকে হত্যা করবে এই বুলেট, কিন্তু মানবশরীরে আঁচড়টুকু পড়বে না। এলরিখের সালভারসান থেকে ফারমাসিউটিকাল শিল্পের রমরমার শুরু। একের পর এক ওষুধ এসে বদলে দিল চিকিৎসার দুনিয়া, মানবশরীর হয়ে উঠল যুদ্ধক্ষেত্র, অসুখের কারণ জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। শরীরকে উপনিবেশ বানিয়ে রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ, সেখানে আমাদের শরীর লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফসল, এমন ভাবার সময় কোথায়?

এই সামরিক চিকিৎসায় কাজ হয়নি, তা কিন্তু নয়। বিগত শতকের শুরুর দিকে একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার জীবাণুঘটিত অসুখের চিকিৎসায় প্রায় নতুন যুগ এনেছে। যদিও, একটু খতিয়ে দেখার পর জানা গেছে যে জীবাণুঘটিত অসুখে মৃত্যুর হার কমতে শুরু করেছে অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কারের আগেই, জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের কারণে। ওই যে বললাম, বেশঁ-র কথা, যা কিনা শেষে পাস্তুরও মেনেছিলেন, শুধু জীবাণুর উপস্থিতিই যথেষ্ট নয়, শরীরের আভ্যন্তরীণ পরিবেশে গোলযোগ না-হলে জীবাণুও অসুখ বাধাতে পারে না। কিন্তু, অসংক্রামক অসুখবিসুখের ক্ষেত্রে চিকিৎসার উন্নতি অতটা চমকপ্রদ হলো না।

অপ্রাসঙ্গিক, নাকি ধান ভানতে শিবের গীত মনে হচ্ছে? ভাবছেন, এসবের মধ্যে ডারউইন’ই বা কোথায়, আর তাঁর বিবর্তনবাদই বা কোথায়? এতদূর যখন এসেই পড়েছেন, চলুন, আরেকটু দেখে নিই।

ডারউইনিয়ান মেডিসিন বা ইভোলিউশনারি মেডিসিন বা বিবর্তনবাদী চিকিৎসাবিজ্ঞান – একটি ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা

শুধু জীবাণু নিকেশ ক’রে অনেক অসুখ সারলো বটে, কিন্তু, নিত্যনতুন চিকিৎসার সাথে পাল্লা দিয়ে আসতে থাকলো নতুন অসুখও। বিশেষত, আমাদের জীবনযাত্রার ধরণের বদলের সাথে বদলাতে লাগলো আমাদের অসুখের ধাঁচ। নতুন সমস্যা হলো, জীবনশৈলীগত অসুখ বা লাইফস্টাইল ডিসিজ। জীবনযাত্রার আর চিকিৎসা, দুইয়ের মানোন্নয়নের সাথে মানুষের গড়-আয়ু বাড়ার সাথে আমাদের অসুখ এবং স্বাস্থ্যসমস্যাগুলি প্রায় মূলগতভাবেই পরিবর্তিত হয়ে গেলো। গত শতকের শুরুতে মানুষের মৃত্যুর মূল কারণ ছিল বিভিন্ন সংক্রামক রোগ; কিন্তু, এক শতকের শেষে, বিশেষত উন্নত দেশে, মানুষের মৃত্যুর প্রথম পাঁচ-ছ’টি কারণের মধ্যে একটিও জীবাণুঘটিত অসুখ নয়। কাজেই, শুধুমাত্র ম্যাজিক বুলেট দিয়ে সমস্যার সমাধান হলো না। চিকিৎসাবিজ্ঞানী’রা প্রায় বাধ্য হলেন বাঁধা পথের বাইরে গিয়ে নতুন ক’রে ভাবতে। অসুখের কারণ খুঁজতে গিয়ে, তাকাতে হলো, শুধুমাত্র বাইরে থেকে আসা জীবাণু নয়, মানবশরীরের ভিতরেও। অনেক অসুখেরই কারণ পাওয়া গেল আমাদের জিনের মধ্যে।

এই সময়েই, আরেকদল চিকিৎসাবিজ্ঞানী আমাদের অসুখের বা অসুস্থ হওয়ার প্রবণতার কারণ অন্বেষণে ডারউইন সাহেব বা তাঁর বিবর্তনবাদের শরণাপন্ন হলেন। দেরিতে হলেও জন্ম হলো ডারউইনিয়ান মেডিসিন অথবা ইভোলিউশনারি মেডিসিন, সহজ বাংলায়, বিবর্তনবাদী চিকিৎসাবিদ্যার।

Darwin after death
বিবর্তনবাদী চিকিৎসাবিজ্ঞান – বিষয়টা কী?

প্রথমেই ব’লে নেওয়া যাক, এই বিবর্তনবাদী চিকিৎসাবিজ্ঞান কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের নতুন কোনো ধারা নয়, বা বলা ভালো, চলতি চিকিৎসাপদ্ধতির বাইরে নয়। বিবর্তনবাদী চিকিৎসাবিদ্যার অর্থ চিকিৎসাবিজ্ঞানের ধাঁধা বা না-মেলা অঙ্কগুলি’কে বিবর্তনের আলোয় নতুন ক’রে দেখা। এর লক্ষ্য, অসুখের কারণগুলিকে বিবর্তন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের সূত্র ধ’রে বিচার করা। পাশাপাশি, তথাকথিত এই অসুখ বা অসুখের উপসর্গগুলি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মূল সুর মেনে সত্যিই কি আমাদের কোনো সাহায্য করছে, সেই’টা খতিয়ে দেখাও অন্যতম উদ্দেশ্য। আর, যদি আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে, অসুখবিসুখ প্রাকৃতিক নির্বাচনের মুখ্য উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করছে, তাহলে বাস্তব আর তত্ত্বের গরমিলের ব্যাখ্যাও এই বিবর্তনবাদী চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম কর্তব্য।

বিবর্তনবাদী চিকিৎসাবিজ্ঞান – কিছু প্রয়োগ

ধরুন, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মূল কথা হলো, শুধুমাত্র সেই জিনই বিশেষভাবে নির্বাচিত হবে বা পরের প্রজন্মে পরিবাহিত হবে, যাতে সেই জিনের বা আমাদের প্রজাতির প্রজননক্ষমতা সর্বাধিক উপকৃত হবে। কিন্তু, এই যে ধরুন, আমরা খেতে ভালোবাসি, তার ওপর আবার সেই-সব খাবার খেতে ভালোবাসি, যেমন তেলতেলে বা মিষ্টি খাবার, যাতে কিনা আমাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় অনেকগুণ। আর, এ-কথা তো সবাই জানে যে, মোটা হলে অসুখবিসুখ, বিশেষত হৃদরোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায় অনেকগুণ। তাহলে, আমাদের এমন খাবার পছন্দ কেন, যা খেলেই আমরা মোটা হয়ে যাবো? কই, এমনও তো হতে পারতো যে, আমাদের উচ্ছেসেদ্ধ বা পেঁপে খাওয়ার প্রতি অদম্য আকর্ষণ, এতটা’ই যে সামনে ওই-সব দেখলে নিজেদের আর আটকে রাখা যায় না? আবার, দেখুন, শুয়ে-বসে থাকতেই আমরা সবাই ভালোবাসি। কিন্তু, এ তো সবারই জানা যে নিয়মিত ব্যায়াম শুয়ে-বসে থাকার চাইতে ঢের ভালো! তা’হলে, আমাদের সুঅভ্যেসের জিনগুলো ছেড়ে বেখাপ্পা বদভ্যেসের জিন এলো কেন? এইসব বদভ্যেসের জিন তো কোনোভাবেই আমাদের আয়ু দীর্ঘায়িত করছে না, অথবা বাড়াচ্ছে না পরবর্তী প্রজন্মে জিন প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা। তাহলে, প্রাকৃতিক নির্বাচন বা যোগ্যতমের উদ্বর্তন, যা কিনা ডারউইনবাদের মূলসূত্র, এই ঘটনা কি তার সম্পূর্ণ বিপরীত প্রমাণ নয়?

কিন্তু, একবার বিবর্তনের সময়ের মাপে নিজেকে ভাবুন। এই জিন তো কয়েক হাজার কি লক্ষ বছরের উত্তরাধিকার। সভ্যতার আদিযুগে যখন মানুষকে খাবার খুঁজে খেতে পেতে হতো, সামান্য অস্ত্রে তুলনায় শক্তিশালী জন্তুকে বধ করলে তবেই জুটতো খাবার। খাবারের এই অনিশ্চয়তাই শিখিয়েছে সুযোগ পেলে প্রয়োজনের বেশি খেতে, শরীরে খাবার চর্বি হিসেবে জমিয়ে রাখতে। প্রকৃতি থেকে সাধারণভাবে আহৃত খাবারে মিষ্টি বা তেলতেলে খাবারের সংখ্যা নামমাত্র। তাই তো ওই দুষ্প্রাপ্য খাদ্যে আমাদের অনিবার্য লোভ। নিত্যদিনের সাধারণ জীবন যখন ঘোর অনিশ্চিত আর শ্রমসাধ্য, তখন থেকেই আমাদের সামান্য অবকাশে একটু গড়িয়ে নেবার অভ্যেস। এখন, বর্তমান সভ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে এইসব অভ্যেসে আমাদের উলটে ক্ষতি হচ্ছে, কিন্তু এদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ভুললে চলবে কেন! হ্যাঁ, হয়তো প্রাকৃতিক নির্বাচনের অমোঘ নিয়মে একদিন আমাদের উত্তরাধিকারী’রা মিষ্টি ছেড়ে উচ্ছে খেতে ভালোবাসবেন, কিম্বা সামান্য অবকাশ পেলে, কোনো স্বাস্থ্যের লোভে নয়, নিজে থেকেই বিশ্রামের চাইতে জিমে দৌড়াদৌড়ি করবেন – কিন্তু, আমাদের জিন নির্বাচিত হয়ে উজ্জ্বল সেইদিন আসতে কয়েক হাজার বছর বাকি।

একই কথা প্রযোজ্য আমাদের জীবনযাত্রাঘটিত অন্যান্য অসুখের ক্ষেত্রেও। আমাদের খাদ্যে আলাদা ক’রে নুন খাওয়ার অভ্যেস বেশিদিনের নয়। কাজেই, বিবর্তনগতভাবেই আমাদের শরীরের রেচনতন্ত্র এতও লবণ সামলে উঠতে পারে না। অত্যধিক চর্বিও সে-রকম’ই পরিপাকতন্ত্রের পক্ষে মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। গাছপালা থেকে পাওয়া জটিল শর্করার স্থান যে মুহূর্তে নিলো কারখানাজাত সরল শর্করা, একই ধরণের সমস্যা দেখা দিলো শরীরের পক্ষে সেই শর্করা সামলানোর ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, যদি একবার ভেবে দেখি যে, আমাদের শরীরটি শিকার বা জঙ্গল থেকে জোগাড় ক’রে আনা খাবার হজম করা আর সেই-মতো শারীরিক শ্রমের জীবনের প্রস্তুতি নিয়ে তৈরি হয়েছে, আর এই নিয়মের বাইরে গেলেই বিভিন্ন রোগব্যাধি অবধারিত, তা’হলে আমরা আমাদের পক্ষে অসুখের ধাঁচটা অনুধাবনে কিছু সুবিধা হয়।

অথবা ধরুন, সবচেয়ে যে সাধারণ অসুখ চারপাশে, সেই জ্বরের কথা। কোনো সংক্রমণ হলে জ্বর হয় কেন? যাঁরা কিছুটা খবর রাখেন, তাঁরা বলবেন, জীবাণুর মোকাবিলা করতে শরীরে কিছু রাসায়নিক নিঃসরিত হয়, তারই প্রভাবে এই জ্বর। বেশ। কিন্তু, রাসায়নিক না-হয় বেরোল, তার জন্যে এই তাপমাত্রা বাড়ার যুক্তি’টা কী? আমাদের কি তেমন একটা জিন নির্বাচিত হতে পারলো না, যাতে এইসব রাসায়নিক বের হয়ে জীবাণুর মোকাবিলা করলো, কিন্তু শরীরের তাপমাত্রা অনর্থক বাড়লো না? কিন্তু, এই তাপমাত্রা বাড়াটা কি সত্যিই নিষ্প্রয়োজন? ঠান্ডা রক্তের প্রাণী, যেমন টিকটিকি ইত্যাদি, জীবাণু-দ্বারা আক্রান্ত হলে গরম স্থানে থাকার চেষ্টা করে। গবেষণায় এ’ও দেখা গিয়েছে যে, সেই সময়ে, টিকটিকি’কে গরম স্থানে না-যেতে দিলে প্রাণীটি মারা যায়। শিশু খরগোশ’ও শরীরের তাপমাত্রা জ্বরের মাধ্যমে বাড়াতে পারে না, তারাও সংক্রামিত হলে উষ্ণতর স্থান খোঁজে। পূর্ণবয়স্ক খরগোশ অবশ্য শরীরের তাপমাত্রা বাড়াতে পারে, কিন্তু, ওষুধ দিয়ে জ্বর কমালে তাদের মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কাজেই, অনুমান করা যায়, জ্বর, অর্থাৎ এই শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে ফেলার ক্ষমতা সংক্রামক ব্যাধির মোকাবিলায় আমাদের সাহায্য করে। এই চিন্তা থেকেই শুরু হয় একাধিক ক্লিনিকাল ট্রায়াল, যাতে দেখা যায় যে, ভাইরাল সংক্রমণের ক্ষেত্রে (যেখানে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না) প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দিয়ে জ্বর কমিয়ে দিলে অসুখ সারতে সময় বেশি লাগে। ঠিক একইরকমভাবে, আমাদের অসুখের মোকাবিলায় ব্যথা বা যন্ত্রণার প্রয়োজন আছে, অন্তত বিবর্তনবাদী চিন্তা তা’ই বলে। তাহলে কি আমরা জ্বরের ওষুধ খাবো না, বা প্রবল যন্ত্রণাতেও খুঁজবো না তাৎক্ষণিক উপশম? নিশ্চয়ই খাবো। শুধু মনে রাখতে হবে, সবসময় উপসর্গের প্রশমন চাইলে কিছু ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হতে পারে।

আবার দেখুন, দীর্ঘমেয়াদী অসুখে ভুগলে আমাদের শরীরে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে যায়, ডাক্তারবাবু’ও চট ক’রে আয়রণ টনিক দিয়ে থাকেন। কিন্তু, রক্তে আয়রণ কমে যাওয়ার যে সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে কোনো সদর্থক ভূমিকা থাকতে পারে, এমনটি কেউই ভাবেন না। কিন্তু, যদি খতিয়ে দেখা যায়, তাহলে বোঝা যাবে, যেহেতু অনেক রোগজীবাণুর বেঁচে থাকার জন্যে পারিপার্শ্বিক লৌহ একটি অবশ্য-প্রয়োজনীয় মৌল, আমাদের শরীরে লৌহের হ্রাস হয়তো রোগনিবৃত্তির অন্যতম পথ। ধরুন, ডিমের কথা। কাঁচা ডিমের বাইরের খোলসে থাকে অসংখ্য সূক্ষ্ম ছিদ্র, তা-সত্ত্বেও ডিমের মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ প্রায় হয়ই না। অন্যতম কারণ হলো, ডিমের মধ্যে যেটুকু আয়রণ থাকে, তার পুরোটাই থাকে তার কেন্দ্রে, কুসুমে। বাইরের সাদা অংশে এমন একটি রাসায়নিক থাকে, যা আয়রণকে সম্পূর্ণ আটকে দেয়। ব্যাকটেরিয়ার বেঁচে থাকার জন্যে অবশ্য-প্রয়োজনীয় লৌহ না-পাওয়া’টা ডিমে সংক্রমণ না-হওয়ার একটি কারণ। তেমনই, দীর্ঘমেয়াদী অসুখে শরীরে আয়রণ কমিয়ে ফেলা বিবর্তনের সুবাদে পাওয়া আমাদের শরীরের অন্যতম রক্ষণব্যবস্থা। আফ্রিকার দুটি ভিন্ন উপজাতির ওপর নজর রেখে জানা গিয়েছে, যারা মদ্যপানের জন্যে লোহার পাত্র ব্যবহার করেন, অর্থাৎ যাঁদের খাদ্যে অকারণে লৌহের ভাগ বেশি, তাদের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া-অ্যামিবার সংক্রমণের হার অনেকটাই বেশি। আবার যখন যক্ষ্মার ওষুধ আবিষ্কার হয়নি, তখন এ’ও দেখা গিয়েছিল যে, যক্ষ্মাজনিত রক্তাল্পতার চিকিৎসা করা হলে, রোগীর মৃত্যু ত্বরান্বিত হওয়ার সম্ভাবনা। কাজেই, ক্রনিক অসুখে অ্যানিমিয়া হলে সবসময় তা ওষুধ দিয়ে কমানো ভালো না’ও হতে পারে।

শরীরে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যাওয়ার কথাটাও এভাবে দেখা যেতে পারে। সমগোত্রীয় অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় আমাদের শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি, অনেকটাই বেশি। প্রাণিজগতের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে যে, প্রাণীর আয়ুর সাথে রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমানের সরাসরি যোগাযোগ আছে। শরীরের জারক-রাসায়নিক নিষ্ক্রিয়করণের ক্ষেত্রে ইউরিক অ্যাসিডের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যকে বিবর্তনবাদের আলোয় দেখা – কেন আজ অবশ্য-প্রয়োজনীয়

বিবর্তনবাদী চিকিৎসাবিদ্যা রোগনিরাময়ে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, এমন দাবী’টা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। কিন্তু, অনেক অসুখবিসুখেরই কারণ খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে এই নতুন চিন্তাপদ্ধতির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই বিবর্তনের তত্ত্বেও প্রয়োগেই আমরা জেনেছি, চারপেয়ে প্রাণী থেকে দু’পেয়ে-তে উত্তরণের মূল্য আমরা চোকাচ্ছি আমাদের হাঁটু কিম্বা কোমরের ব্যথার মাধ্যমে, মানুষের সন্তানপ্রসব’ও জটিল এক’ই কারণে। বিবর্তনের চিন্তার প্রয়োগে উত্তর মিলেছে ক্যানসার মনুষ্যপ্রজাতির মধ্যে কেন এতও বেশী – এই প্রশ্নের। অনেক মানসিক রোগের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও পেয়েছি এই পথেই। যে জিন আমাদের বুড়ো করে, সেই জিন’ই যে আমাদের প্রথমজীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ; কাজেই, আমরা বুড়ো কেন হই, আর বার্ধক্যের জন্যে দায়ী জিনের চিকিৎসা ক’রে অক্ষয়যৌবনের অধিকারী হওয়ার প্রচেষ্টা কেন অনুচিত, সেই অমোঘ সাবধানবাণী’ও এসেছে এই চিন্তাপদ্ধতির বিচারে।

সত্যি বলতে কি, বিবর্তনবাদের সঠিক প্রয়োগ চিকিৎসার দর্শনে আমূল বদল আনতে পারে। আমাদের শরীরকে একটি নিখুঁত যন্ত্র হিসেবে দেখার যে আধুনিক প্রবণতা, সেখানে চিকিৎসকের ভূমিকা নিছক মেকানিকের। বিবর্তনবাদী বিচারের অবস্থান প্রায় এর বিপ্রতীপে। অনেক সহস্র বছরের পথ-চলার অভিজ্ঞতায় আমাদের এই যে বর্তমান মানবশরীর, তা খুঁতহীন তো নয়ই, হওয়ার প্রশ্নও ওঠে না। শরীরের অনেক ধর্মই প্রায় বিনিময়-বাণিজ্যের নিয়মে পাওয়া, কিছু পেতে গিয়ে ছাড়তে হয়েছে অন্য কিছু – তদুপরি, অনেকক্ষেত্রেই, যেমন ভাবা হয়েছিল, বাড়িতে এসে হিসেব মেলেনি – অর্থাৎ, যেমন ধরুন, কোষবিভাজনের ভুলত্রুটির দিকে নজর রাখার দায়িত্ব ছিলো যার, পরবর্তীতে সেই জিন’ই ক্যানসারের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের চোখের বিবর্তন এবং আমাদের শরীরে ভিটামিনের যোগানের উপর নির্ভর ক’রে আমাদের রেটিনার গড়ন এমন যে, আমাদের অপটিক নার্ভ বিশেষ এক সঙ্কুচিত পথে চোখ থেকে বের হতে বাধ্য হয়েছে, যার জন্যে আমাদের মেনে নিতে হয়েছে একটু ব্লাইন্ড স্পট। প্রাকৃতিক নির্বাচনের শর্ত আমাদের দুর্ভেদ্য বা অমর করা নয়, তার কাজ আমাদের এমনভাবে তৈরি করা, যাতে আমাদের জিন আমরা পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করতে পারি সর্বোত্তম দক্ষতায়। এই কথাগুলো মাথায় রাখলে চিকিৎসকের কাজ কিছুটা সহজ হয়। আমরা যদি মেনে নিই যে, এই শরীর প্রকৃতির নিয়ম মেনেই তৈরি, এবং প্রকৃতির আর পাঁচ’টা জিনিসের মতো শরীরটিও অসাধারণ, কিন্তু নিখুঁত নয়, একমাত্র তা’হলেই মানবশরীরকে সম্পূর্ণ খুঁতহীন করার নিরন্তর প্রয়াসের চাপ কিছুটা হাল্কা হয় – আখেরে তাতে ডাক্তার কিম্বা রোগী, উভয়েরই মঙ্গল।

তবু বিবর্তনবাদ চিকিৎসাবিজ্ঞানে আজও অবহেলিত – কিন্তু কেন?

রোগ বা অসুস্থতার বিবর্তনবাদী চিন্তার প্রসার যতটা হতে পারতো, ততখানি হয়নি। প্রথমত, এই চিন্তাধারায় চটজলদি সমাধান মেলে না। বিবর্তনবাদী চিন্তাধারা সাথে আজকের তাৎক্ষণিক, প্রায় ধর-তক্তা-মার-পেরেক চিকিৎসাচিন্তার ফারাক প্রায় আলোকবর্ষের। দ্বিতীয়ত, এবং সম্ভবত এটি’ই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, ডাক্তারবাবুদের বিবর্তনবাদী চিন্তা, এমনকি বিবর্তনের মূল কথাগুলি বিষয়ে বিশেষ ধারণা নেই। ডাক্তারি শিক্ষার কোনো পর্যায়েই বিবর্তনের তত্ত্ব কিম্বা প্রাকৃতিক নির্বাচন বিষয়ে পড়ার সুযোগ থাকে না। স্বাভাবিকভাবেই, চিকিৎসার জটিল সমস্যার সমাধানে বিবর্তনের তত্ত্বের প্রয়োগের চিন্তা তাঁদের মাথায়ই আসে না। কিন্তু, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান যখন অনেক সমস্যার উত্তর পাচ্ছে না, তখন ডারউইনের তত্ত্ব তাঁদের পথ দেখাতে পারে, এই ধারণা আজ অনেক বিশেষজ্ঞেরই। তাই, বিবর্তনের তত্ত্ব বিষয়ে অজ্ঞতা কাটাতে পশ্চিমের অনেক দেশেই দাবী উঠেছে যাতে, ডারউইনের বিবর্তনের তত্ব বা প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণা ডাক্তারি শিক্ষায় অবশ্যপাঠ্য বেসিক সায়েন্স কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত হয়।

অথচ, ইতিহাস সাক্ষী, আমাদের দেশে, আমরা জীবন বিষয়ে সম্যক জ্ঞানার্জন’কে চিকিৎসাবিদ্যার মুখ্য উদ্দেশ্য হিসেবে জেনে এসেছি। অনুধাবন করেছি, কীভাবে প্রকৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে বেঁচে থাকতে হয়, আর সেই প্রকৃতিবিচ্যুতির ফল আমাদের অসুখবিসুখ – জেনেছি, সেই প্রকৃতির সঠিক আত্মীকরণের মাধ্যমেই যথার্থ রোগমুক্তি। বিবর্তনবাদী চিকিৎসাবিজ্ঞানের মূলসূত্রগুলি তো এর থেকে বেশি দূরে নয়। আমাদের সুযোগ ছিলো, আমাদের ঐতিহ্যের পথ ধরেই, এই বিবর্তনবাদী চিকিৎসাচিন্তনে সারা বিশ্বকে পথ দেখানোর। কিন্তু, তার পরিবর্তে, দুর্ভাগ্য আমাদেরই, আমাদের দেশনেতারা তো নিজের চোখে দেখেননি বলে ডারউইনের তত্ত্বকে’ই উড়িয়ে দিতে চাইছেন। হয়তো, তাঁদের পক্ষে, এ’হেন গভীর চর্চার চেয়ে গণেশ’কে বৈদিকযুগে প্লাস্টিক সার্জারির নজির হিসেবে পেশ করাটা ঢের সহজ, এমনকি চটকদারি আমোদেরও।