আলো দিয়ে আলো-শোধন 

আলো দিয়ে আলো-শোধন 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৫

আলোকে আমরা সাধারণত বিশুদ্ধতার প্রতীক হিসেবেই দেখি। কিন্তু কোয়ান্টাম প্রযুক্তির সূক্ষ্ম জগতে আলোও হতে পারে ত্রুটিপূর্ণ, ঝাপসা, বিশৃঙ্খল এবং অনিয়ন্ত্রিত। এই ত্রুটিপূর্ণ আলোই আজ কোয়ান্টাম কম্পিউটার ও অতিনিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় বাধাগুলোর একটি। সেই বাধা ভাঙতেই এক চমকপ্রদ ধারণা সামনে এনেছেন ইউনিভার্সিটি অব আইওয়া–র গবেষকেরা: আলোকে পরিশুদ্ধ করতে হলে, আলোকে দমন করে নয়—বরং আলো দিয়েই আলোকে শোধন করতে হবে।

ফোটনিক কোয়ান্টাম প্রযুক্তির মূল ভিত্তি হলো একক ফোটন কণা। এই ক্ষুদ্র আলোক-কণাগুলোই ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম কম্পিউটারে কিউবিট হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিতে একটি পরমাণুকে লেজার দিয়ে উত্তেজিত করলে প্রত্যাশিত একক ফোটনের পাশাপাশি জন্ম নেয় বাড়তি, অবাঞ্ছিত ফোটন। এই লেজার স্ক্যাটার বিষয়টা ঠিক যেন একটা নিখুঁত সুরের মাঝে ঢুকে পড়া বেসুরো শব্দ—যা পুরো ব্যবস্থার নির্ভরযোগ্যতা নষ্ট করে দেয়।

এর সঙ্গে যুক্ত হয় আরও একটি সূক্ষ্ম সমস্যা। কখনো কখনো পরমাণু একটির বদলে একসঙ্গে একাধিক ফোটন ছেড়ে দেয়। এই বহু-ফোটন নিঃসরণ কোয়ান্টাম গণনার শৃঙ্খলা ভেঙে দেয়, কারণ কোয়ান্টাম ব্যবস্থা ফোটন চায় একে একে, নির্দিষ্ট ক্রমে -একসঙ্গে নয়।

এই দুই সমস্যার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল সমাধানের সূত্র। পদার্থবিদ্যার স্নাতক গবেষক ম্যাথিউ নেলসন দেখান যে,বহু-ফোটন নিঃসরণ থেকে তৈরি আলোর তরঙ্গরূপ ও তরঙ্গদৈর্ঘ্য আশ্চর্যজনকভাবে লেজার আলোর সঙ্গে মিলে যায়। এই মিলকে কাজে লাগিয়েই গবেষকেরা প্রস্তাব করেছেন এক অভিনব কৌশল—লেজারের কোণ, আকার ও দিক এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে লেজার স্ক্যাটার ও অবাঞ্ছিত ফোটন একে অপরকে বাতিল করে দেয়।

ফলে যে লেজার ব্যাঘাত এতদিন কোয়ান্টাম প্রযুক্তির শত্রু ছিল, সেটিই হয়ে উঠল সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। যে লেজার ব্যাঘাত এতদিন সমস্যা ছিল, সেটিকেই ব্যবহার করে অবাঞ্ছিত বহু-ফোটন নিঃসরণ দমন করা সম্ভব। ফলে অবশিষ্ট থাকে এক অত্যন্ত বিশুদ্ধ একক ফোটনের প্রবাহ। একক ফোটন উৎসের শব্দ-সহায়ক পরিশোধন প্রকাশিত হয়েছে অপটিকা কোয়ান্টাম জার্নালে।

এই শৃঙ্খলাবদ্ধ ফোটন প্রবাহ শুধু প্রযুক্তিগত দক্ষতাই বাড়ায় না, বাড়ায় নিরাপত্তাও। গবেষকেরা একে তুলনা করেছেন ক্যান্টিনের লাইনের সঙ্গে—যেখানে সবাই একসঙ্গে হুড়োহুড়ি করলে বিশৃঙ্খলা বাড়ে, আর একে একে চললে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি সহজ হয়।

যদিও গবেষণাটি এখনও তাত্ত্বিক পর্যায়ে, সফল পরীক্ষামূলক প্রমাণ মিললে এটি ফোটনিক কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও অতিনিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বাস্তব জীবনের খুব কাছে নিয়ে আসতে পারে। আলোকে শোধনের এই ধারণা হয়তো ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম সভ্যতার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হয়ে উঠবে।

 

সূত্র: Noise-assisted purification of a single-photon source by Matthew D. Nelson, Ravitej Uppu, et.al; published in Optica Quantum, 2025; 3 (6): 500

DOI: 10.1364/OPTICAQ.565878.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine + 6 =