ইতিহাসের তপ্ততম বছর ২০২৪

ইতিহাসের তপ্ততম বছর ২০২৪

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৯ নভেম্বর, ২০২৫

আন্তর্জাতিক জলবায়ু বিজ্ঞানীদের নতুন বিশ্লেষণ বলছে, পৃথিবী গত এক লক্ষ পঁচিশ হাজার বছরের মধ্যে কখনও এতটা গরম হয়নি, যতটা ২০২৪ সালে হয়েছে। আন্তঃসরকারি জলবায়ু পরিবর্তন সংস্থা আই পিসিসি-র তথ্য ও শতাধিক বৈজ্ঞানিক সূচক বিশ্লেষণ করে এটাই জানা যাচ্ছে। প্রধান গবেষক অধ্যাপক উইলিয়াম রিপল বলেছেন, “আমরা এখন এমন এক যুগে এসে পৌঁছেছি যেখানে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের সীমা অতিক্রম করেছে। একে বলা চলে জলবায়ু-চালিত বিশৃঙ্খলা।” ২০২৪ সালের তাপমাত্রা কেবল একটা সাধারণ ‘গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির’ ঘটনা নয়, এটি বহু পরিবেশগত সূচকের সম্মিলিত অস্থিরতার পরিণাম। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইডের ঘনত্ব আজ ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সেই সঙ্গে সমুদ্রের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে, বরফের স্তর গলেছে দ্রুততর হারে। সমুদ্রের অম্লত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক এক হুমকি। বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের গ্রহ এখন এমন এক “অতি উত্তপ্ত দশায় ” পৌঁছেছে যেখানে সামান্য দশমিকের হেরফেরও বিপর্যয়ের সীমারেখা নির্ধারণ করতে পারে। ২০২৪ সালে কয়লা, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি জীবাশ্ম জ্বালানি-র ব্যবহার নতুন রেকর্ড ছুঁয়েছে। যদিও নবায়নযোগ্য শক্তি যেমন সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ দ্রুত বাড়ছে, কিন্তু তা এখনও মোট জ্বালানি ব্যবহারের তুলনায় খুবই নগণ্য। এই উষ্ণতা বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ, বায়ুমণ্ডলে সূক্ষ্ম বাষ্প-কণার (এরোসোল) পরিমাণ হ্রাস। এই সূক্ষ্ম কণাগুলি সূর্যের কিছু তাপ প্রতিফলিত করে পৃথিবীকে সামান্য ঠান্ডা রাখে। কিন্তু কণার পরিমাণ কমে যাওয়ায় পৃথিবীর প্রতিফলন ক্ষমতা (আলবেডো) হ্রাস পেয়েছে, ফলে আরও বেশি তাপ জমা হচ্ছে। তাছাড়া জলবায়ুর বিক্রিয়াচক্র, যেমন বরফ গলে যাওয়ায় আরও বেশি সূর্যালোক শোষণ, মেঘের বিন্যাস পরিবর্তন, ও সাগরের উষ্ণতা – সবই এই উত্তাপ বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে। এই অতিরিক্ত তাপমাত্রার পরিণাম এখন স্পষ্ট। ইউরোপে ২০২৪ সালে এক মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে। সমুদ্রের তাপমাত্রা এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যা অদৃষ্টপূর্ব। যুক্তরাষ্ট্রে টেক্সাসে ভয়াবহ বন্যায় শতাধিক মানুষ মারা গেছেন, লস অ্যাঞ্জেলেসে জলবায়ুজনিত ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে ২৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতিটি মহাদেশেই জলবায়ু বিপর্যয়ের ছাপ স্পষ্ট- আফ্রিকায় খরা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অতিবৃষ্টি, অ্যান্টার্কটিকায় বরফ গলে যাওয়া। সব মিলিয়ে এ এক বৈশ্বিক সংকেত। বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, পৃথিবী “ওভারশুট দশায়” আছে – অর্থাৎ আমরা যে হারে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করছি, প্রকৃতি তা পুনরুদ্ধার করতে পারছে না। মানুষের জনসংখ্যা, গবাদিপশু উৎপাদন, মাংসভিত্তিক খাদ্যগ্রহণ ও ভোগবাদী জীবনধারা পৃথিবীর পুনরুজ্জীবন ক্ষমতা ধ্বংস করছে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে হলে শুধু কার্বন নির্গমন কমানোই যথেষ্ট নয়। আমাদের খাদ্যব্যবস্থা, ভূমি ব্যবহার, বন সংরক্ষণ ও জ্বালানি ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি।

 

সূত্র : The 2025 state of the climate report: a planet on the brink Free William J Ripple, et.el;

BioScience, biaf149, 29 October 2025

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × 2 =