উদ্বেগ, অনিদ্রা ও রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা 

উদ্বেগ, অনিদ্রা ও রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫

আজকাল আধুনিক জীবনের অনিবার্য সঙ্গী হয়ে উঠেছে উদ্বেগ ও অনিদ্রা। দ্রুতগামী জীবনযাত্রা, অনিশ্চয়তা ও মানসিক চাপের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই সমস্যাগুলোকে প্রায়ই আমরা সাময়িক বা তুচ্ছ বলে এড়িয়ে যাই। ফ্রন্টিয়ার্স ইন ইমিউনোলজি–তে প্রকাশিত সৌদি আরবের এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্বেগ ও অনিদ্রা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ ন্যাচারাল কিলার সেল (এন কে কোষ)/ প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা কোষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিতে পারে।

ন্যাচারাল কিলার কোষ (এন কে) রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রথম সারির যোদ্ধা। এই কোষগুলোই সংক্রমণ ও অস্বাভাবিক কোষের বিরুদ্ধে শরীরের প্রথম প্রতিরক্ষা বলয় গঠন করে। ভাইরাসে আক্রান্ত কোষ, অস্বাভাবিক বা ক্যান্সারজনিত কোষ শনাক্ত করে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কোষগুলো রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে টহল দেয় এবং সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আগেই হস্তক্ষেপ করে। ফলে এন কে কোষের সংখ্যা কমে গেলে শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে।

এই গবেষণাটি পরিচালিত হয় সৌদি আরবের ১৭ থেকে ২৩ বছর বয়সি ৬০ জন নারী শিক্ষার্থীর ওপর। প্রশ্নাবলীর মাধ্যমে তাদের উদ্বেগ ও অনিদ্রার মাত্রা নির্ধারণ করা হয় এবং পাশাপাশি রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক ঘাতক কোষের পরিমাণ বিশ্লেষণ করা হয়। ফলাফল উদ্বেগজনক। দেখা যায়, প্রায় ৫৩ শতাংশ শিক্ষার্থী অনিদ্রার উপসর্গে ভুগছিলেন, আর ৭৫ শতাংশের মধ্যে উদ্বেগের লক্ষণ ছিল—যার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মাঝারি থেকে তীব্র উদ্বেগে আক্রান্ত।

গবেষণায় এন কে কোষের দুটি প্রধান উপধরন বিশ্লেষণ করা হয়। এর মধ্যে CD16+CD56dim ধরনের কোষ সরাসরি ক্ষতিকর কোষ ধ্বংসে সবচেয়ে কার্যকর, আর CD16+CD56high কোষ দেহে রাসায়নিক বার্তা বহনকারী প্রোটিন নিঃসরণে ভূমিকা পালন করে। উদ্বেগে আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই দুই ধরনের টহলদার এন কে কোষের সংখ্যা ও অনুপাত দুটোই কমে যায়। বিশেষ করে যাদের উদ্বেগ মাঝারি বা তীব্র, তাদের শরীরে এই কোষগুলোর ঘাটতি সবচেয়ে স্পষ্ট ছিল।

অনিদ্রার ক্ষেত্রেও অনুরূপ চিত্র দেখা গেছে। যেসব শিক্ষার্থী ঘুমের সমস্যায় ভুগছিলেন, তাদের মোট এন কে কোষ এবং এর উপশ্রেণির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। উদ্বেগ যত বেড়েছে, এন কে কোষের পতন ততই তীব্র হয়েছে—যা মানসিক চাপ ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার মধ্যে সরাসরি যোগসূত্রের ইঙ্গিত দেয়।

গবেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, এন কে কোষের এই ঘাটতি ভবিষ্যতে সংক্রমণ, দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এবং দেহের প্রতিরক্ষা কাঠামোকে ক্ষয় করে দীর্ঘমেয়াদে নানা জটিল রোগের পথ প্রশস্ত করতে পারে।

তবে গবেষণাটির সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। অংশগ্রহণকারীরা সবাই তরুণী হওয়ায় ফলাফলকে সর্বজনীনভাবে প্রয়োগ করা যায় না। তবু এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়— উদ্বেগ ও অনিদ্রা কেবল মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা নয়, এগুলো ধীরে ধীরে শরীরের প্রতিরক্ষা দেয়ালকেও ভেঙে দিতে পারে।

 

গবেষকদের মতে, নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক চাপ কমানো, সুষম খাদ্য ও পর্যাপ্ত ঘুম এন কে কোষের কার্যকারিতা রক্ষায় সহায়ক হতে পারে। সুস্থ মন ও সুস্থ শরীর যে আলাদা নয়, বরং একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ—এই গবেষণা সেই সত্যকেই আরও একবার জোরালোভাবে ফুটিয়ে তুলল ।

 

 

সূত্র : Insomnia and anxiety: exploring their hidden effect on natural killer cells among young female adults by Renad M. Alhamawi, Fatmah A. Halawani, published in Frontiers in Immunology, 15th December 2025.

DOI: 10.3389/fimmu.2025.1698155

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

15 − 7 =