
সম্প্রতি কানাডার দক্ষিণ-পশ্চিম আলবার্টা অঞ্চলে পাওয়া গেল মাত্র ১.৬ ইঞ্চি লম্বা অ্যাক্রোনিচথিস ম্যাককোগনোই নামক এক ক্ষুদ্র মাছের জীবাশ্ম। এ আবিষ্কার সমগ্র মৎস্য প্রজাতির বিবর্তনের ইতিহাসের মোড় ঘোরালো । এই ক্ষুদ্র জীবাশ্মটি প্রমাণ করেছে, উত্তর আমেরিকায় স্বাদু জলের মাছেদের বিবর্তনের ইতিহাস আমরা যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক প্রাচীন এবং জটিল।
গবেষণাটি পরিচালনা করেছে পশ্চিম অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়, রয়্যাল টাইরেল প্যালেওন্টোলজি মিউজিয়াম এবং এক আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী-দল। তাঁদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই জীবাশ্মটি পরবর্তী ক্রিটেশিয়াস যুগের, অর্থাৎ ৬৬ থেকে ১০০ মিলিয়ন বছর আগের। এটি এখন পর্যন্ত উত্তর আমেরিকায় পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন ওটোফাইসান মাছের প্রতিনিধি।
ওটোফাইসানরা পৃথিবীর মিঠে /স্বাদু জলের মাছদের মধ্যে সবচেয়ে সফল গোষ্ঠী। এর মধ্যে রয়েছে ক্যাটফিশ, কার্প এবং টেট্রা প্রজাতি। এদের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো “ওয়েবেরিয়ান অ্যাপারেটাস” – যা একটি সূক্ষ্ম হাড়ের সেতু। এটিই মাছের বায়ুভর্তি সাঁতারথলি থেকে অন্তঃকর্ণের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে। এই গঠন শব্দ ও কম্পনকে তীব্রভাবে অনুভব করতে সাহায্য করে , ঠিক যেমন মানুষের কানের ক্ষুদ্র হাড়গুলো শব্দের তীব্রতা বাড়িয়ে তোলে।
চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, অ্যাক্রোনিচথিস ম্যাককোগনোই -এর ভেতরেও এই শ্রবণযন্ত্রটি নিখুঁতভাবে গঠিত ছিল। অর্থাৎ, আধুনিক শ্রবণক্ষমতার এই বিবর্তন শুরু হয়েছিল বহু কোটি বছর আগেই।
এই জীবাশ্মটি এতটাই সূক্ষ্ম যে বিজ্ঞানীরা সেটিকে হাতে স্পর্শ করতেও সাহস পাননি। তাঁরা ব্যবহার করেছেন সিঙ্ক্রোট্রন এক্স-রে মাইক্রো-সিটি স্ক্যানিং, যা হাজারো অতিক্ষুদ্র রশ্মিচিত্রকে একত্র করে এক নিখুঁত ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরি করে। ফলে হাড়ের অভ্যন্তরীণ প্রতিটি গঠন স্পষ্টভাবে দেখা গেছে একটি অংশও না ভেঙে।
এই গবেষণা শুধু যে একটি নতুন প্রজাতিকে তুলে ধরল তা নয়, এটি মাছের অভিবাসনের ইতিহাসেরও এক নতুন দিগন্ত । বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ওটোফাইসান মাছেরা প্রথমে সমুদ্রজীবী ছিল, পরে তারা স্বাদু জলে অভিযোজিত হয়। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, এই স্থানান্তর ঘটেছে একবার নয় অনেক বার।
প্রায় ১৫৪ মিলিয়ন বছর আগে, যখন মহাদেশগুলো ধীরে ধীরে আলাদা হচ্ছিল, তখন পরিবর্তনশীল উপকূল ও নদীপথ এদের জন্য নতুন পরিবেশ তৈরি করেছিল। সেই সময়ের সাময়িক লবণাক্ত-মিঠে জলীয় সংযোগপথ হয়তো ছিল তাদের বিবর্তনের সেতু। আলবার্টার এই জীবাশ্ম ক্ষেত্রটি মূলত ডাইনোসর জীবাশ্মের জন্যই বিখ্যাত, কিন্তু অ্যাক্রোনিচথিস ম্যাককোগনোই -এর জীবাশ্ম দেখিয়ে দিল যে সেই যুগেও উত্তর আমেরিকার নদীগুলোতে উন্নত শ্রবণক্ষম মাছ ছিল।
আজকের দিনে ওটোফাইসানরা পৃথিবীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ স্বাদু জলের মৎস্য প্রজাতির প্রতিনিধি। তারা নদী ও হ্রদের খাদ্যজাল বজায় রাখে, শৈবাল খায়, পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করে এবং পুরো জলজ পরিবেশকে সজীব রাখে।
ক্ষুদ্র এই মাছটি যেন কোটি বছরের বিবর্তনের সেতুবন্ধন , নীরব অথচ মহিমান্বিত, ইতিহাসের বুকে লুকানো এক চরম বিস্ময়।
সূত্র : Marine origins and freshwater radiations of the otophysan fishes by Alison M. Murray, Neil R. Banerjee,et.al; published in science journal,
( 2.10.2025).