
পানামার কোইবা জাতীয় উদ্যানের ঠিক পাশে ছোট্ট দ্বীপ জিকারন। প্রাইমেটদের জন্য যেন এ এক স্বর্গ। কিন্তু এই নির্ভেজাল দৃশ্যপটের আড়ালে, ২০১৭ সালে শুরু হয় এক নিঃশব্দ বিপ্লব।ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ অ্যানিম্যাল বিহেভিয়ার এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা ২০১৭ সালে এই উদ্যানে ক্যাপুচিন বানর পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। ক্যামেরা ট্র্যাপে খুঁজছিল বানরের ‘অভিনব কৌশল ’—হাতিয়ার ব্যবহার, সামাজিক আচরণ ইত্যাদি। কিন্তু ২০২২-এ এক ভিডিও তাদের সামনে এনে ফেলে আচরণের এক নতুন অধ্যায়—নাম দেওয়া যায় ‘কৃষ্টি কেন্দ্রিক অপহরণ’। ক্যামেরায় ধরা পরে, একদল তরুণ ক্যাপুচিন বানর (গবেষকেরা এর নাম দেন জোকার) অন্য প্রজাতির শিশু বানরদের বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। স্নেহের ছলে বা উদ্ধারের জন্য নয়, এমনকি সামাজিক অনুশীলন বা সঙ্গীদের কাছ থেকে সুবিধা পেতে নয়। তাহলে? অপহরণের তাগিদে। প্রথমে দেখা যায় এক তরুণ ক্যাপুচিন, হাউলার বানরের একটি বাচ্চাকে বুকে আঁকড়ে ধরে আছে। তারপর পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যায়, ১৫ মাসের মধ্যে আরও চারজন তরুণ ক্যাপুচিন পুরুষ, একের পর এক ১১টি শিশু হাউলার বানরকে একইভাবে বহন করতে শুরু করে। এই ‘অপহরণ প্রথা’ ছড়িয়ে পরে গোটা গোষ্ঠীর মধ্যে। যেন একরকমের আদিম খেলা, যার শেষ প্রান্তে আছে শিশুমৃত্যু। গবেষক জোয়ে গোল্ডসবোরো-র জবাব সরল: “এই প্রথার আমরা কোনো উপকার দেখিনি। কিন্ত ক্ষতির সম্ভাবনা অনেক”। ইতিমধ্যে চারটি হাউলার ছানা মারা গেছে। বাকি যারা অপহৃত হয়েছিল, তাদের কজন বেঁচে তারও হদিশ নেই – থাকার কথাও নয়। গবেষকেরা একে বলছেন কৃষ্টির সংক্রমণ। কেউ একজন আচরণ শুরু করলে, বাকিরা ভাবনা না করেই তা অনুসরণ করতে থাকে। শুনে কেমন যেন চেনা চেনা লাগে না? আমরা, মানুষ, কত শত ‘ঐতিহ্য’ মেনে চলি যার উৎস বা প্রাসঙ্গিকতা আমরা জানিও না। কেবল কেউ শুরু করেছে বলে, আমরা চালিয়ে যাই। পরিচালক মেগ ক্রোফুট বলছেন,”জিকারনে জীবন খুব সহজ। না আছে শিকারী, না আছে খাদ্যসংকট। ফলে অঢেল সময়। অফুরন্ত সময়ের একঘেয়েমি থেকেই জন্ম নিচ্ছে এই আচরণ। এটি উদ্ভাবন নয়, বরং এক কৃষ্টি জাত বিকৃতি। প্রয়োজনীয়তা সবসময় ভালো আবিষ্কারের জন্ম দেয় না, বরং মাঝে মাঝে একঘেয়েমি থেকে জন্ম হয় বিকৃতির।”এই আচরণ এখনও অব্যাহত আছে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এই অপকৃষ্টি যদি মাথাচাড়া দেয়? তাহলে হাউলার বানরের মতো একটি বিপন্ন প্রজাতি পড়বে বিপদের মুখে। ধ্বংসও হয়ে যেতে পারে সম্পূর্ণ একটি জনসমষ্টি। জিকারনের ‘জোকার’রা হয়ত আমাদের অন্ধত্বকেই আয়না ধরেছে। কৃষ্টি মানেই কি সত্যিকারের উত্তরাধিকার? নাকি অনেক সময়, সেটিই নিঃশব্দ বিকৃতির নতুন নাম!