
এক সময় বলা হত মাধ্যমিক এত সহজ যে তাতে ফেল করতে নাকি খাটনি লাগে। এখন, ওয়াটসাপ গ্রাজুয়েটদের “মুরগী” করতে তার থেকেও কম কষ্ট করতে হয়।
এইরকম ভার্বাল বোমা ছুড়ে কেন শুরু করলাম? আসুন সেকথায় আসা যাক। আজ(২১/৪) সকাল থেকে ওয়াটসাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে একটা লিংক ক্রমাগত আসা যাওয়া করছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে লিংকটার সোর্স আমাদের দেশের নামকরা গয়ানার দোকান কল্যান জুয়েলার্স। লিংক খুললে প্রস্তাব: ৫টা গ্রুপ আর ২০ জনকে ফরোয়ার্ড করে সোনার গিনি জিতে নিন। লোকজন অফিস-টফিস, রান্না-বান্না, কাজ-কম্মো কোনোক্রমে সামলে ফরোয়ার্ড করতে শুরু করে দিয়েছেন। আমার নিজের পরিবারের ওয়াটসাপ গ্রুপ উপচে পড়ছে; কাউকে কিছু বলতে গেলেই গালাগাল খাচ্ছি। লিংকের দাবি? এইরকম ফরোয়ার্ড করতে করতে ১০০% হয়ে গেলেই গিনি নিশ্চিত! উত্তেজনার পারদ চরমে! ব্লাড প্রেশার চড়ছে! থমথমে আবহাওয়া; এসবের মধ্যে কিছু বলতে গেলেই আমি গাল খাচ্ছি!
এরপর হঠাৎ সব পালটে গেল। কেন? কী এমন ঘটতে পারে? উত্তর সহজ; অংকের হিসাবে যা ঘটার তাই ঘটেছে। কেউই আর ১০০% অবধি পৌছতে পারছেন না। কেউ ৯৩, কেউ ৯৬, কেউ ৯৯.৩% পর্যন্ত গিয়ে নট নড়নচড়ন! আবেগের বাঁধ ভেঙে পড়েছে! আর আমি? আরো গালাগাল খাওয়ার ভয়ে চুপ করে আছি। ঠিক এই পজিশনে এই লেখাটা লিখছি।
তাহলে? করণীয়? আসুন এবার একে একে প্রশ্নগুলোয় আসা যাক। প্রথমত, আমাদের মধ্যে কতজন ওয়েবসাইটের লিংকটা খেয়াল করেছিলেন? যে বিখ্যাত দোকানের নামে লিংকটা আসে তাদের ওয়েবসাইটের সঙ্গে এই থ্রেডটার মিল কতটা? উত্তর ০%! “kallgc.cyou” আমাদের কলকাতা শহরে অবস্থিত কোনো গয়নার দোকানের ওয়েবসাইট হতে পারে কি? সাধারণ যুক্তি কী বলে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নি যে লিংকটা সঠিক দোকান থেকেই এসেছে, তাহলেও, সকলে ১০০% অবধি পৌছে গেলে সে দোকানকে যতগুলো গিনি বিনামূল্যে দিতে হবে, তারপর আর কখনও তাদের পক্ষে ব্যবসা করা সম্ভব কি? আবারও, সাধারণ যুক্তি কী বলে? তৃতীয়ত, শতাংশের হিসাবে আসি। একটা সহজ এ্যালগোরিদমে চোখ বোলানো যাক! ধরুন আমি এই লিংকটির ব্যাকএণ্ড (নেপথ্যের) কোডিং করেছি। সেই কোডের যুক্তি:
১) প্রথম ফরোয়ার্ডে, যিনি করছেন তিনি ৫০% পাবেন।
২) এরপর থেকে প্রত্যেক ফরোয়ার্ডে তার নতুন বৃদ্ধি আগের বৃদ্ধি-শতাংশের অর্ধেক হবে।
অর্থাৎ? পর পর কয়েকটা ধাপে অংকটা এইরকম দাঁড়ায়:
ধাপ ১ : ৫০ %
ধাপ ২ : ৫০ + ২৫ = ৭৫ %
ধাপ ৩ : ৭৫ + ১২.৫ = ৮৭.৫ %
ধাপ ৪ : ৮৭.৫ + ৬.২৫ = ৯৩.৭৫ %
এইভাবে চললে
ধাপ ৭ দাঁড়ায় : ৯৮.৪৬ + ০.২৬ = ৯৮.৭৩ %
তাহলে, এই সামান্য এ্যালগোটুকুতেও কি জীবনে ১০০% অবধি পৌছনো সম্ভব? না! এটা সেই লিমিট টেন্ডস টু, বা ইনফিনিটেসিমালের হিসাব।
এবার আরেকটু ভাবা যাক। উপরের হিসাব যদি সবার ক্ষেত্রে লাগু করা হয় তাহলে পাশা-পাশি বসে ফরোয়ার্ড করা দুজন মানুষ তাদের যে বোকা বানানো হচ্ছে তা সহজেই ধরে ফেলতে পারবেন! অতএব করণীয় কী? যুক্তিটাকে আরো একটু কঠিন করা যাক। প্রথম ধাপটা আপাতত একই থাকলো, দ্বিতীয়টাকে পালটানো যাক।
১) প্রথম ফরোয়ার্ডে, যিনি করছেন তিনি ৫০% পাবেন।
২) এরপর থেকে প্রত্যেক ফরোয়ার্ডে তার নতুন বৃদ্ধি আগের বৃদ্ধি-শতাংশের অর্ধেকের নীচে যেকোনো শতাংশ হতে পারে।
এখানে আমি যেটা করলাম তাকে “র্যান্ডোমাইজেশান” বা যদৃচ্ছকরণ(?) বলা যেতে পারে। অর্থাৎ দ্বিতীয় ধাপের বৃদ্ধি পাশাপাশি বসে ফরোয়ার্ড করা দুজনের আর এক থাকলো না। এটুকু করলেই নির্দিষ্ট কোনো ধাপে একজন পোছবেন ৯৩-এ আর অন্যজন ৯১ শতাংশে। এরপরেও ধরা পড়ার ভয় থাকলে, প্রয়োজনে “মন্টে কারলো র্যাণ্ডোমাইজেশান”-এর মতো এ্যালগোরিদম ব্যবহার করে খেলাটাকে আরো যেমন-তেমন করা যেতে পারে। সেটা যিনি কোডিং করছেন তাঁর ক্ষমতা এবং যিনি/যারা করাচ্ছেন তাঁদের বাজেটের উপর নির্ভর করছে। তবে শেষমেশ আর যাই হোক যারা ফরোয়ার্ড করছে তাদের যে ১০০ শতাংশে পৌছনো হচ্ছে না, এটা পাকাপোক্ত করা হল।
কিন্তু তাও, এত অংক, এ্যালগোরিদম বা কঠিন কঠিন কোডিং-এর কথা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র প্রথম দুটো প্রশ্নের কথা ভাবলেও অবাক হয়ে যাই। আমাদের কেউ ওয়েবসাইটের এ্যাড্রেসটা মিলিয়ে দেখলেন না? কোনো ব্যবসায়ীর পক্ষে অতগুলো সোনার গিনি বিনামূল্যে দিয়ে দেওয়া যে চাইলেও সম্ভব নয় সেটা ভাবলেন না? চোখ বন্ধ করে ফরোয়ার্ড করবার আগে এই লিংকটি যে ভাইরাস বা সাইবার এ্যাটাক হতে পারে সেটা চিন্তা করলেন না? আমরা বাঙালিরা কী সত্যিই কাঙালি হয়ে গেলাম? দুটো গিনির ছবি দেখিয়ে আমাদের দিয়ে যা খুশি করিয়ে নেওয়া যায়?
সব শেষে, আজকের এই ওয়াটসাপ ইউনিভার্সিটি সেশান থেকে বৃহত্তর যে আরেকটা কথা বেরিয়ে এল তা এই:
যে কেউ, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বা অধর্মীয় বা চোর-ডাকাতদের যে কোনো প্রতিষ্ঠান সামান্য ফাণ্ডিং থাকলেই নির্দিষ্ট অর্থমূল্যে আমাদের (দেশ, রাজ্য, গ্রাম, মফস্বল, শহর… সব) যেমন খুশি বুঝিয়ে, যা ইচ্ছে তাই করিয়ে নিতে পারে। কাজেই যতদিন না সামান্য যুক্তিবোধে আমরা অভ্যস্ত হওয়ার কথাটুকু ভাবতে পারি, ততদিন ওই নির্দিষ্ট কোডিং-টির মত ডার্টি-জব মুহূর্তে সামলে বুদ্ধিমান ‘ব্যবসায়ীরা’ গিনির পর গিনি উপার্জন করে চলুন, আর তাদের রোব্বারের ঝোল কষতে দিয়ে-
আসুন আবার মুরগী হই!