কারা ভারতীয় জনগোষ্ঠী

কারা ভারতীয় জনগোষ্ঠী

দেবব্রত কর
Posted on ২২ আগষ্ট, ২০২১

এখন বিজ্ঞাপনের অবদানে ইতালির দেশীয় খাবার পিৎজার প্রবেশ ঘরে ঘরে। পিৎজা তৈরি দেখেছেন? লক্ষ্য করে থাকবেন একটা মোটা রুটির ওপর বিভিন্ন সব্জি, মাংস, চিজ পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে গরমাগরম পরিবেশন করা হয়। এই পিৎজার রন্ধনপ্রণালীর স্তরগুলোর সঙ্গেই অদ্ভুত সাদৃশ্য খুঁজে নিয়েছেন ‘আর্লি ইন্ডিয়ান’ বইয়ের লেখক বিখ্যাত সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক টনি যোশেফ। সুন্দরভাবে এটি ব্যাখ্যা করেছেন ‘ইন্ডিয়া টুডে’র প্রাক্তন সাংবাদিক শেখর গুপ্ত তাঁর ইউটিউব চ্যানেল “ দ্য প্রিন্ট”এ। আসলে আমরা ভারতীয়রা হাজার হাজার বছর ধরে ঘটে চলা পৃথিবীর বিভিন্ন ভৌগোলিক অংশের জিনগত বিন্যাসের ধারকদের মিশ্রণ। এ যেন সত্যিই ‘শক হুণদল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন’।
ব্যাপারটা বেশ খানিকটা পেছন থেকে শুরু করা যাক। আজ থেকে ১,৭০,০০০ বছর আগে আফ্রিকা মহাদেশের উত্তরপূর্ব অংশ থেকে একদল মানুষ খাবার ও শিকারের পিছু নিয়ে লোহিত সাগরের উত্তর অংশ দিয়ে বর্তমানে যেখানে সিরিয়া,ইজরায়েল, লেবানন, সেখানে পৌঁছায়। তখন তাদের ছেড়ে আসা আফ্রিকার উত্তরপূর্ব (বর্তমান মিশর) অংশ তুষারযুগের প্রভাবে মরুভূমিময় হয়ে গেছিল। আর এশিয়ার এই অংশ যেটা লেভান্ত নামেও পরিচিত, সেটা ছিল সবুজে ভরা। জলের প্রভূত যোগানও ছিল। কিন্তু সেখানে আগে থেকেই আমাদের পূর্বপুরুষদের সমসাময়িক অন্য কয়েকটি মনুষ্যপ্রজাতি (হোমো ইরেকটাস, নিয়েন্ডারথাল,ডেনিসোভানস) দের বসবাস ছিল। তারা কেন জায়গা ছাড়বে? আর জলবায়ুর পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন অনুযায়ী ওখানেও যখন তুষারযুগ শুরু হল তখন আমাদের পূর্বপুরুষরা নতুন জায়গায় মানিয়ে নিতে পারল না। পুরনো আফ্রিকার বাসস্থানেও ফিরতে পারল না। অপরদিকে অন্য প্রজাতিরা ওই এলাকায় অনেকদিন থাকার কারনে অভ্যস্ত ছিল। ফলে সহজেই আমাদের আফ্রিকান পূর্বপুরুষরা জীবনযুদ্ধে হেরে যায় এবং নিশ্চিহ্ন হয়।
এরপর আনুমানিক ৬০,০০০ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকার আমাদের পূর্বপুরুষদের একটা অংশ লোহিত সাগরের দক্ষিণভাগ দিয়ে আরবভূমি পেরিয়ে এশিয়ায় আসে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাপ্ত আধুনিক মানুষের (হোমো স্যাপিয়েন্স) ফসিলের জিনগত বিশ্লেষণে জানা গেছে এই আফ্রিকানরাই সারা পৃথিবীতে এরপর আধুনিক মানুষের অস্তিত্বের বিস্তার ঘটায়। এদেরই একটি ধারা পারস্য উপসাগর ধরে এগিয়ে যেতে থাকে হাজার হাজার বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে এবং সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল ধরে পৌঁছে যায় বর্তমান ভারতবর্ষের দক্ষিণের ত্রিভুজাকৃতি বিস্তৃত অঞ্চলে। সেখান থেকে বর্তমানের শ্রীলঙ্কা, মালয়ভূমি, আন্দামান, বর্তমানের পাপুয়ানিউগিনি প্রভৃতি অংশে। এই জনগোষ্ঠীকে বলা হয় “এনসেন্ট অ্যানসেসট্রাল সাউথ ইন্ডিয়ান(এ এ এস আই)”।শ্রীলঙ্কার ফা-হিয়েন গুহার আজ থেকে ৩৫ -৪০০০০ বছর আগের সময়কার আধুনিক মানুষের কঙ্কাল এর জিন বিন্যাসের বিশ্লেষণ এই ধারণাকে মান্যতা দেয়।জিন বিদ্যা গবেষণায় মাইটোকন্ড্রিয়াল ডি এন এ এর জিনশাখার (হ্যাপ্লোটাইপ) বিন্যাসে দেখা গেছে এই সময়কার এ এ এস আই জনগোষ্ঠীর মাইটোকনড্রিয়াল ডি এন এ এর হ্যাপ্লোটাইপে প্রাপ্ত L3,M,N,R গ্রুপ ও সাবগ্রুপগুলি একমাত্র আফ্রিকার জনগোষ্ঠীতেই পাওয়া যায়। আমাদের সেই অতি প্রাচীন ভারতীয় পূর্বপুরুষরা যে আফ্রিকাত্যাগীদেরই শাখাপ্রশাখা সেই ধারণা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়। এই আফ্রিকাত্যাগী অংশ সমগ্র ইউরোপেও আধুনিক মনুষ্যজাতির বিস্তার করে। সেখানে আবার L3 এর সাবহ্যাপ্লোটাইপের N আর R মাইটোকন্ড্রিয়াল ডি এন এ এ ধারী মনুষ্যজাতির আধিক্য। সে আর এক অন্য গল্প। (চলবে)

ছবি সৌজন্যে: দ্য পলিসি টাইমস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × 3 =