কার্বন ডাই-অক্সাইডে ব্যাহত মহাকাশ যোগাযোগ

কার্বন ডাই-অক্সাইডে ব্যাহত মহাকাশ যোগাযোগ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৭ নভেম্বর, ২০২৫

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ক্রমবর্ধমান কার্বন ডাই-অক্সাইড শুধু উষ্ণতাই বাড়াচ্ছে না, বদলে দিচ্ছে আকাশের উচ্চস্তরের গঠন। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে উপগ্রহ ও রেডিও যোগাযোগের স্থিতিশীলতা। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের একদম উপরের স্তর আয়োনোস্ফিয়ার প্রায় ৮০ থেকে ৬০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে বায়ুকণাগুলি সূর্যের বিকিরণে আয়নিত হয়ে থাকে। এই স্তরই মূলত রেডিও তরঙ্গ প্রতিফলন ও স্যাটেলাইট যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড-এর ঘনত্ব বাড়ার ফলে এই স্তরের তাপমাত্রা ও ঘনত্ব দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। একদিকে নিম্নবায়ুমণ্ডল উষ্ণ হচ্ছে, অপরদিকে উচ্চবায়ুমণ্ডল ঠান্ডা হয়ে হালকা হচ্ছে। এই ‘দ্বিমুখী উষ্ণতা পরিবর্তন’ পৃথিবীর রেডিও তরঙ্গের চলাচল ও উপগ্রহের গতিপথে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। জাপানের কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুইসিন লিউ দেখিয়েছেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধি সরাসরি প্রভাব ফেলছে ‘স্পোরাডিক-ই’ নামে পরিচিত একটি সূক্ষ্ম আয়নিত স্তরে। এটি প্রায় ৯০ থেকে ১২০ কিলোমিটার উচ্চতায় গঠিত। এই স্তর থেকেই উচ্চ-কম্পাঙ্ক ও অতিউচ্চ-কম্পাঙ্কের রেডিও সংকেত প্রতিফলিত হয়। এই স্তরের অবস্থান বা ঘনত্ব সামান্য পরিবর্তিত হলেই রেডিও যোগাযোগে তীব্র অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। নতুন মডেল অনুযায়ী, যদি কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা আজকের তুলনায় দ্বিগুণে পৌঁছায়, অর্থাৎ মিলিয়ন পিছু ৩১৫ পার্টস পার মিলিয়ন থেকে বেড়ে ৬৬৭ পার্টসে পৌঁছায়,তাহলে এই স্পোরাডিক-ই স্তর আরও ঘন ও অস্থির হবে। বিশেষ করে, রাতের দিকে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠবে। উচ্চ-কম্পাঙ্ক ও অতিউচ্চ-কম্পাঙ্কের তরঙ্গের উপর নির্ভর করে সাগর, আকাশপথ, প্রতিরক্ষা, এমনকি আন্তর্জাতিক সম্প্রচারও। কিন্তু আয়নোস্ফিয়ারের পরিবর্তন হলে এই তরঙ্গের প্রতিফলন বা প্রসারণের পথ বদলে যায়। ফলে সংকেত দুর্বল হয়ে যেতে পারে। একাধিক প্রতিফলন তৈরি হতে পারে। কিংবা নির্দিষ্ট দূরত্বে বিচ্ছিন্নতা ঘটতে পারে। অর্থাৎ হঠাৎ করে সংকেত গন্তব্যে পৌঁছাবে না। উপগ্রহ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও সমস্যাটি জটিল। উচ্চস্তরের বায়ুর ঘনত্ব কমে গেলে উপগ্রহর উপর বায়ুপ্রতিরোধ কমে যায়। এতে প্রথমে মনে হতে পারে উপগ্রহ আরও সহজে কক্ষপথে থাকবে, কিন্তু এর ফল বিপরীতও হতে পারে।কারণ এতে মহাকাশে ছড়িয়ে থাকা স্পেস ডেব্রিস বা অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ দীর্ঘদিন সক্রিয় থেকে সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। গবেষক লিউ বলেন, “আমরা এতদিন ভেবেছি জলবায়ু পরিবর্তন শুধুই পৃথিবীর নীচের স্তরের ব্যাপার, কিন্তু এখন স্পষ্ট হচ্ছে এটি ‘মহাকাশ আবহাওয়া’-রও অংশ।“ অর্থাৎ, যেভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড মাটির তাপমাত্রা বাড়ায়, সেভাবেই এটি আয়নোস্ফিয়ারের ভারসাম্য বদলে রেডিও তরঙ্গের গতিপথেও প্রভাব ফেলে। সম্পর্কটি এতদিন কল্পনাতীত ছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এখন থেকেই নতুন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রথমত, নিয়মিত আয়নোস্ফিয়ার মনিটরিং চালু রাখা জরুরি। যেমন GNSS সিগন্যাল সিনটিলেশন ও আয়নোসোন্ড পর্যবেক্ষণ। দ্বিতীয়ত, রেডিও তরঙ্গ চলাচলের পূর্বাভাস মডেলে শুধুমাত্র সৌর ও চৌম্বকীয় প্রভাব নয়, বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব ও তাপমাত্রার পরিবর্তনকেও যুক্ত করা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, উপগ্রহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভিযোজিত ফ্রিকোয়েন্সি ও ‘পোলারাইজেশন বৈচিত্র্য’ ব্যবস্থাপনা বাড়াতে হবে,যাতে সংকেত বিচ্যুতি হলে দ্রুত সামঞ্জস্য আনা যায়। সব মিলিয়ে এই গবেষণা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কার্বন ডাই-অক্সাইডের বৃদ্ধির প্রভাব এখন ভূমি থেকে শুরু করে মহাকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত। যদি এই অদৃশ্য পরিবর্তনগুলিকে সময়মতো বোঝা ও প্রতিরোধ করা না যায়, তবে ভবিষ্যতে উপগ্রহ যোগাযোগ, রেডিও ন্যাভিগেশন ও এমনকি বিমান চলাচলও অনির্দেশ্যভাবে বিঘ্নিত হতে পারে।

সূত্র : How Does Increasing CO2 Concentration Affect the Ionospheric Sporadic-E Formation? By Farhan Naufal et.el; 23 October 2025

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

sixteen + nine =