
সালোকসংশ্লেষণ-কে একটি সৌর-শক্তি চালিত রান্নাঘর হিসাবে কল্পনা করা যায়। রাঁধুনি – উদ্ভিদ, শৈবাল, এবং কিছু ব্যাকটেরিয়া, রান্নার নানা উপকরণ যেমন পাতার সবুজ রঞ্জক ক্লোরোফিল দ্বারা শোষিত সূর্যালোক, জল এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে, নিজস্ব শক্তি-পূর্ণ খাবার-গ্লুকোজ (একধরনের শর্করা) এবং অক্সিজেন তৈরি করে। এই রান্নার সবচেয়ে ভালো গুণ হলো উপজাতক হিসেবে অক্সিজেন উৎপাদন – যা বাকি প্রাণীকুলের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। সালোকসংশ্লেষণ শুধু উদ্ভিদকে জীবিত রাখে না – সমগ্র গ্রহকে চালিত রাখে। খাদ্য শৃঙ্খলের ভিত্তি হিসাবে ছোট মাকড় থেকে শুরু করে বিশাল স্তন্যপায়ী সবকিছুকেই একটি ধারায় জীবিত থাকতে সাহায্য করে। এখন প্রধান প্রশ্ন হল, গাছের পাতার আলো-কণা বা ফোটন পাকড়াও করার দক্ষতার অনুকরণ বা তার উন্নতিসাধন করা যায় কি?
‘সুপারপজিশন’ নামে একটি পরিচিত ধারণা অনুযায়ী, শক্তি বা কণা একাধিক সম্ভাব্য অবস্থায় বা দশায় একে অপরের সাথে মিশে থাকতে পারে। অদ্ভুত শোনালেও, উদ্ভিদরা তাদের সৌর গ্রহণমাত্রাকে সর্বাধিক করার লক্ষ্যে, কোটি কোটি বছর ধরে এই ধারণাকেই কাজে লাগিয়ে চলেছে । “যখন একটি পাতায় আলো শোষিত হয়, তখন ইলেকট্রনের উত্তেজনা শক্তি, প্রতিটি উত্তেজিত ক্লোরোফিল অণুর বেশ কয়েকটি অবস্থার মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। একে উত্তেজিত অবস্থার সুপারপজিশন বলা হয়।” এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন টিইউএম থেকে প্রফেসর হাউয়ার। এই প্রক্রিয়ার একটি বড় অংশ জড়িত ক্লোরোফিল-এর সাথে, যা নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যর আলো শোষণ করে।
কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণের নকশায়, গবেষকরা দেখার চেষ্টা করেছেন, একবার একটি পাতা আলো ধরে নেওয়ার পর, সেটি তাপ হিসাবে ছড়িয়ে পড়ার আগেই সেই শক্তিকে স্থানান্তরিত করা যায় কিনা। এই প্রক্রিয়া অবিশ্বাস্য রকম দ্রুত গতিতে ঘটে। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, সালোকসংশ্লেষক ব্যাকটেরিয়ার স্থিতিশীল ইলেকট্রন-পথগুলি ওই একইভাবে কাজ করে। “কোয়ান্টাম মেকানিক্স হল শক্তির স্থানান্তর এবং চার্জ বিভাজনের প্রথম পদক্ষেপগুলি বোঝার জন্য আদর্শ,” হাউয়ার বলেন। এই শক্তিপ্রবাহকে উদ্ভিদ পরিচালিত করে কোষের রাসায়নিক কেন্দ্রের দিকে । তাঁরা বলেন, “কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণ নকশায়, এই ফলাফলগুলি বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং আলোক রসায়ন বা ফটোকেমিস্ট্রির জন্য সৌরশক্তিকে সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করার কাজে সাহায্য করতে পারে”।
বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, ক্লোরোফিলে একাধিক ইলেকট্রনিক অবস্থা একে ওপরের ওপর চড়ে বসে (ওভারল্যাপ করে)। তারা এমন পথ তৈরি করে যেখানে আলোর স্পন্দন খুব বেশি বাধা ছাড়াই সরে যেতে পারে। এই প্রায়-অবাধ প্রবাহ রসায়নবিদ এবং পদার্থবিজ্ঞানীদের আরও গভীরে গিয়ে দেখতে উৎসাহিত করে। এটি শক্তিকে ক্ষয় বা নির্গমন থেকে রক্ষা করে। শক্তির নির্গমন হতে পারে, অবস্থার সংযোগ এবং তাপের আকারে। গবেষকরা অতিদ্রুতগামী লেজার ব্যবহার করেন যা একটি ট্রিলিয়নতম সেকেন্ড- স্থায়ী স্পন্দন নির্গত করে। ( ১ ট্রিলিয়ন = ১০ এর ১২ ঘাত ) এই লেজার তাঁদের এই প্রাথমিক পরিবর্তনগুলি দেখতে সাহায্য করে। আরও নিবিড়ভাবে দেখলে, নির্দিষ্ট শক্তি ব্যান্ডের মধ্যে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এটিই সামগ্রিক স্থানান্তর শৃঙ্খলকে স্থিতিশীল রাখে। এভাবে অণুর দূরত্ব ও কোণে ছোট ছোট সমন্বয় ঘটিয়ে ক্লোরোফিল তাদের শোষিত সূর্যালোক কতটা দক্ষতার সাথে হস্তান্তর করে, সে বিষয়ে বড় পরিবর্তন আনা যেতে পারে। সাবেকি পদার্থবিজ্ঞান এই ঘটনাগুলিকে পুরোপুরি বর্ণনা করতে পারে না, কিন্তু কোয়ান্টাম পদ্ধতিগুলি এই ফাঁকটি পূরণ করতে পারে বলে মনে করা হয়। এই গবেষণার প্রধান লক্ষ্য হল এমন এক কৃত্রিম উপায় তৈরি করা, যা আলোকে আরও বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারবে এবং যেখানে প্রয়োজন সেখানেই পাঠাতে পারবে । কিছু গবেষকের ধারণা, এই কাঠামোগুলি সূক্ষ্মভাবে ফটো-ডিভাইস (আলো কৌশল ) তৈরি করতে সাহায্য করবে। বিজ্ঞানীদের আশা, তাঁরা কৃত্রিম উপায়ে উদ্ভিদ এবং সালোক সংশ্লেষক ব্যাকটেরিয়ার এই দক্ষতা তৈরি করতে পারবেন। এটি সৌরশক্তি সঞ্চয়ের পদ্ধতিকে নতুনভাবে কল্পনা করে, এমন নকশা তৈরি করতে পারবে, যাতে সূক্ষ্ম আণবিক নৃত্য অক্ষত থাকে।