
প্রোটিন যেন নিঃশব্দ এক জটিল যন্ত্র। এর একেকটা সংকেতে, সেকেন্ডের ভগ্নাংশেই রূপ বদলায়। কখনও পেশী সঙ্কোচনে, কখনও স্নায়বিক সংকেত প্রেরণে, আবার কখনও বিপাক নিয়ন্ত্রণে সব কিছুর কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকে এই অণুগুলি। বিজ্ঞান বহুদিন ধরেই প্রোটিনের এই অদ্ভুত ক্ষমতা ধরতে চেয়েছে। শক্ত, নির্দিষ্ট কাঠামোর প্রোটিন তৈরি করেই বানানো হয় ইনসুলিন, জীবাণুনাশক, শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক। কিন্তু এসব কাঠামোতে গতিশীলতা ছিল না। অথচ গতিশীলতা প্রাকৃতিক প্রোটিনদের একেবারে চেনা বৈশিষ্ট্য। সেই ছক ভাঙলেন UCSF-এর অধ্যাপক তানজা কর্টেমে ও তার গবেষণাদল। তাদের কাজ থেকে দেখা গেল, কৃত্রিম প্রোটিনও, প্রাকৃতিক প্রোটিনের মতনই সংকেত পেলে রূপান্তরিত হতে পারে। তাদের তৈরি এক ধরনের প্রোটিন, ছোট্ট একটি ‘সুইংগিং সেগমেন্ট’ বা দোলায়মান উপাংশ যোগ করে ক্যালসিয়াম আয়নের উপস্থিতিতে নিজের গঠন বদলায়। বৈজ্ঞানিকভাবে বিষয়টি যাচাইও করা হয় শক্তিশালী কম্পিউটেশনাল মডেলিং এবং পারমাণবিক চৌম্বকীয় অনুরণন (NMR) বা সিমুলেশনের মাধ্যমে। মুখ্য গবেষক অ্যামি গুও, বলেছেন, “আমরা এমন একটি প্রোটিন বানাতে চেয়েছিলাম, যা সংকেত পেলে রূপ বদলে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, আবার বিশ্রামে ফিরে আসবে।” এই ‘অন-অফ’ কাঠামো ভবিষ্যতের চিকিৎসা ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। গবেষকরা ভাবছেন, এমন প্রোটিন বানানো সম্ভব, যা ক্যানসার সনাক্ত করে নিজের গঠন পাল্টে, নিরাময়কারী উপাদান ছাড়বে এবং তারপর আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কমবে। এবং এই রূপান্তরের ক্ষমতা শুধু চিকিৎসাতেই সীমাবদ্ধ নয়। পরিবেশবিদেরা দেখেছেন, একই প্রোটিন দূষণ সনাক্ত করে নিষ্ক্রিয় করে, আবার পুনরায় চালু হয়ে নতুন কাজে লাগতে পারে। কৃষিক্ষেত্রও বাদ নেই। এমন প্রোটিনের পরিকল্পনা করা সম্ভব, যেগুলি তাপমাত্রা বা আর্দ্রতা বুঝে ফসলকে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার শক্তি যোগাবে। এমনকি কিছু গবেষক কল্পনা করছেন এমন এক প্রোটিন-ভিত্তিক উপকরণের যা তাপমাত্রা বাড়লে বা যান্ত্রিক চাপ পড়লে নিজে থেকেই রূপ পাল্টে আরও স্থিতিশীল হয়ে উঠবে। এইসব উদ্ভাবন একটি মৌলিক সত্যকে সামনে আনছে- প্রোটিনের রূপান্তরশীলতা কেবল একটি বৈশিষ্ট্য নয়, এটি এক ধরনের ‘নকশাগত বুদ্ধিমত্তা’। প্রকৃতি বহু আগে তা আবিষ্কার করেছিল, বিজ্ঞান এখন তা অনুকরণে সক্ষম হচ্ছে। “সম্ভাবনা অফুরন্ত,” গুও বলেন। আগামী দিনের আণবিক প্রযুক্তি হবে গতিশীল, অভিযোজিত, এবং সংকেতনির্ভর। সংকেতের তালে নাচা এই অণুগুলো হয়তো ভবিষ্যতের চিকিৎসা, পরিবেশ রক্ষা এবং ফসল উৎপাদনে মৌলিক বিপ্লব ঘটাবে।