কোয়ান্টাম গণক

কোয়ান্টাম গণক

আনন্দ দাশগুপ্ত
অধ্যাপক, ভৌত বিজ্ঞান বিভাগ, আই.আই.এস.ই.আর , কলকাতা
Posted on ২ নভেম্বর, ২০২৫

পর্ব ১

সাধারণ কম্পিউটারে আমরা যে বিট (bit) নিয়ে কাজ করি, সেটা দুটো দশায় থাকতে পারে – যাদের নাম দেওয়া হয় 0 আর 1। যেমন একটা ডিজিটাল সার্কিটের আউটপুট হয়তো অল্প (ধরা যাক 0 থেকে 0.7 ভোল্ট) – সেটাকে 0 ধরা হয়। আবার সেটাই বেশি (ধরা যাক 4 থেকে 5 ভোল্ট) হলে সেটাকে 1 ধরা যায়। মোদ্দা কথাটা হল, বিট এক সময়ে হয় 0, নয় 1 দশায় থাকবে। সাধারণ কম্পিউটারে বহু বহু বিট নিয়ে কাজ হয়। বলার সুবিধের জন্য আপাতত তিনটে বিটের কথা বলছি – তাদের দশা কোনো এক সময়ে 000, 001, 010, 011, 100, 101, 110, 111 – এই আটটির মধ্যে যে কোনো একটি হতে পারে। বাইনারি সংখ্যার হিসেবে 0 থেকে 7 – এই সবকটা সংখ্যাই এভাবে বোঝানো যাবে। এইরকম কোটি কোটি বিটের দশা পালটে পাল্টেই সাধারণ কম্পিউটার যা করার করে।

 

এবার আসি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কথায়। এর মূলে আছে কিউবিট (qbit) – এটি এমন এক কোয়ান্টাম সিস্টেম যার দুটি দশা হতে পারে। এর নানারকম উদাহরণ হতে পারে। ইলেকট্রনের স্পিন বা পরমাণুর শক্তিস্তর (যেখানে অনেকগুলোর মধ্যে এমন দুটো স্তরকে বেছে নেবো যেগুলোর থেকে ইলেকট্রনের অন্য স্তরে যাতায়াতের সম্ভাবনা কম)। তবে আমরা যে উদাহরণ দিয়ে বেশির ভাগ কথাটা বলবো সেটা হলো আলোর কণা ফোটন। আলোর অন্য অনেক ধর্ম থাকলেও সেগুলো আপাতত উপেক্ষা করে শুধু তার পোলারাইজেশনের দিক (যেটা তার কণার স্পিনের দিকের সাথে সম্পর্কিত) নিয়ে কথা বলা যাক। যদি X আর Y অক্ষের দিকে আলো পোলারাইজড হয়, তাহলে তার ফোটনের দশা দুটোকে যথাক্রমে |0> আর |1> বলতে পারি। এই | > চিহ্নটা কোয়ান্টাম তত্ত্বে দশা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। এর পোশাকি নাম হলো কেট (ket)। এরকম বদখত নাম কেন? কোয়ান্টাম মেকানিক্সে অনেক সময় ব্রাকেট (bracket) বলে একটা জিনিস কষতে হয়। সেই ব্রাকেটের ফর্মুলায় ডানদিকের অংশে থাকে এই দশা ভেক্টর – তাই এর নাম কেট!

 

সবচেয়ে বড়ো কথাটা এইমাত্র বলে দিয়েছি – এগুলো ভেক্টর। এগারো বারো ক্লাসে শেখা দিক আর মান ওয়ালা তীর নয় – তবে তার সাথে এই ভেক্টরের একটা বড়ো মিল আছে ( সেই জন্যই এদের ভেক্টর বলা হয়)। আমাদের চেনা ভেকটরের মতো এদেরও যোগ করা যায় – সংখ্যা দিয়ে গুণও করা যায়। তবে এক্ষেত্রে সংখ্যাগুলো বাস্তব সংখ্যা [real number) হতেই হবে এমন নয় – জটিল সংখ্যা (complex number) ও হতে পারে। তাই একটা ফোটন যে শুধু |0> আর |1> দশায় থাকতে পারে তা নয় –

 

a|0> +b |1>

 

হতে পারে, যেখানে a আর b হলো দুটো জটিল সংখ্যা।

 

যেমন, x অক্ষের সাথে ৪৫ ডিগ্রি কোণে পোলারাইজড ফোটনের দশা বোঝানোর জন্য যে ভেক্টরটা ব্যবহার করতে হয় সেটা হলো

 

(|0> +|1>)/√2

 

এই যে জটিল সংখ্যাগুলো দিয়ে |0> আর |1> ভেক্টরগুলোকে গুণ করা যায়, তাদের তাৎপর্য বোঝা দরকার। আলোর পোলারাইজেশনের চেনা ধর্ম দিয়েই বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করা যাক।

 

পোলারয়েড কাগজের মধ্যে দিয়ে আলো গেলে কি হয় সেটা সবার জানা। ধরা যাক পোলারয়েড কাগজটার অক্ষ X এর দিকে। তার মানে আলোর ইলেক্ট্রিক ফিল্ড ভেক্টর যদি X অক্ষ বরাবর হয় তাহলে সেই আলো পুরোটাই পোলারয়েড ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু যদি আলোর ইলেক্ট্রিক ফিল্ড X অক্ষের সাথে q কোণ করে থাকে, তাহলে শুধু X এর দিকের উপাংশটাই বেরোবে, অন্যটাকে পোলারয়েড শুষে নেবে! তার ফলে ইলেক্ট্রিক ফিল্ডের মান cos(q) দিয়ে গুণ হওয়ায় কমে যাবে। আর আলোর তীব্রতা যেহেতু এর বর্গের সাথে সমানুপাতিক তাই তার ফর্মুলা দাঁড়াবে

 

I = I_0 cos^2 (q)

 

এই সূত্রটার নাম হলো মালুসের সূত্র (Malus’s law) – এটা তোমরা অনেকেই এগারো-বারো ক্লাসে পড়েছো! বিশেষ করে পোলারয়েড যদি আলোর ইলেক্ট্রিক ফিল্ড ভেক্টরের থেকে ৪৫ ডিগ্রি কোণে থাকে, তাহলে তীব্রতা অর্ধেক হয়ে যাবে।

 

তাহলে আলোর তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ ধর্ম থেকে তো এই সূত্রটা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু বারো ক্লাসে তোমরা এটাও পড়েছো যে কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুযায়ী আলোর আবার কণা ধর্মও আছে! এই যে ফোটনগুলোর কথা আমরা বলছি সেগুলো এই আলোরই কণিকা। আলোকে অনেকগুলো ফোটনের স্রোত হিসেবে ভাবলেও মালুসের সূত্র বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। ৪৫ ডিগ্রি কোণের ক্ষেত্রে অর্ধেক ফোটন পোলারয়েড পার করে আর বাকি অর্ধেক শোষিত হয়। একটা ফোটনের শক্তি তার কম্পাংকের উপর নির্ভর করে। সেটা একই থাকে, সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যায় বলেই তীব্রতা অর্ধেক হয়ে যায়। এই অবধি কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ধরা যাক এবার আমাদের আলোর উৎসটার ঔজ্জ্বল্য কমাতে থাকছি। শেষে যদি এমন অবস্থায় পৌঁছাই যেখানে কোনো মুহূর্তে একটাই ফোটন উৎস থেকে বেরোচ্ছে, তাহলে কি হবে?

 

যদি একটা |0> দশায় থাকা ফোটন এই X- পোলারয়েড কাগজের (লেখা কমানোর জন্য আমরা এরপর X অক্ষের দিকে অক্ষওয়ালা পোলারয়েড না বলে স্রেফ X-পোলারয়েড বলবো) উপর পড়ে তাহলে সেটা সরাসরি বেড়িয়ে যাবে। কিন্তু যদি ফোটনের দশা তা না হয়ে |1> হয়, তাহলে পোলারেয়েড ফোটনটাকে শুষে নেবে – বেরিয়ে যাবার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। এবার দেখা যাক, যদি ফোটনের দশা (|0> +|1>)/√2 হয়, তাহলে কি হবে? আগেই বলেছি, এক্ষেত্রে আলোর ইলেক্ট্রিক ফিল্ড আমাদের পোলারয়েডের অক্ষ, মানে X অক্ষের সাথে ৪৫ ডিগ্রি কোণ করে আছে। তাহলে আলোর তীব্রতা অর্ধেক হয়ে যাবার কথা। কিন্তু ফোটন তো আর অর্ধেক হবে না – তার শক্তি, যেটা তার কম্পাংকের উপর নির্ভর করে, সেটাও কমবে না। তাই একটা এই দশার ফোটন এসে পোলারয়েডে পড়লে কি হবে? এক্ষেত্রে কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে ফোটনের ভবিষ্যৎ কিন্তু আর নিশ্চিত নয় – সেটা বেড়োতেও পারে, শোষিত হতেও পারে। ঠিক কোনটা হবে, সেটা বলার কোনো উপায় নেই। শুধু বলা যায় এই দুটো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা সমান – এরকম দশায় অনেকগুলো ফোটন এসে পড়লে তার মোটামুটি অর্ধেক বেরোতে পারবে – সেই জন্যই আলোর তীব্রতা অর্ধেক হয়ে যাবে!

 

কোয়ান্টাম মেকানিক্স আরো বলে a|0> +b |1> দশায় থাকা কোনো ফোটন এই পোলারয়েডের উপর পড়লে সেটা পেরিয়ে যাবার আর শোষিত হবার সম্ভাবনা যথাক্রমে |a|^2 আর |b|^2 এর সাথে সমানুপাতিক। এর থেকে বেশি কিছু জানা সম্ভব নয় – এটাই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রধাণ শিক্ষা। বোঝাই যাচ্ছে যে গোটা ভেক্টরকে কোনো সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে a আর b পাল্টাবে বটে, কিন্তু |a|^2 আর |b|^2 এর অনুপাত পাল্টাবে না! তাই এটা করলে ভেক্টরটা পালটে গেলেও সেটা ফোটনের যে দশার কথা বলছে সেটা পাল্টাবে না। কাজের সুবিধার জন্য আমরা অনেক সময়েই

|a|^2 + |b|^2 = 1

নিয়ে নিই, যাতে |a|^2 আর |b|^2 সরাসরি ফোটনটার দুটো ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দিয়ে দেবে। খেয়াল করো – এক্ষেত্রেও কিন্তু ভেক্টরটা পুরোপুরি নির্দিষ্ট হয় না – তাকে যে কোনো জটিল সংখ্যা z , যার মান |z| = 1, দিয়ে গুণ করা যায়। এই একক মানের সংখ্যার কিন্তু বাস্তবে কোনো গুরুত্ব নেই। এই যে একটু আগে বললাম যে (|0> +|1>)/√2 ভেক্টরটা ৪৫ ডিগ্রি কোণে পোলারাইজড ফোটনকে বোঝায়, তার বদলে -(|0> +|1>)/√2 লিখলেও চলতো, e^(i s) (|0> +|1>)/√2 লিখলেও তফাত হতো না (যেখানে s একটি বাস্তব সংখ্যা) । কিন্তু এটা জোর দিয়ে বলা দরকার যে তাই বলে যেখানে সেখানে e^(i s) (বা মাইনাস সাইন – যেটা s = π হলে আসবে) ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না। (|0> – |1>)/√2 কিন্তু একেবারে অন্য দশা – এক্ষেত্রেও ফোটনটা X অক্ষের সাথে ৪৫ ডিগ্রি কোণে পোলারাইজড বটে, কিন্তু সেটা আসলে – ৪৫ ডিগ্রি! (|0> – |1>)/√2 আর

(|0> + |1>)/√2 দশার ফোটন দিয়ে তৈরি দুটো আলোর ইলেক্ট্রিক ফিল্ড ভেক্টর পরস্পরের সাথ লম্বদিকে থাকবে।

 

এই যে আমরা বললাম, দশা a|0> +b |1> হলে, পেরিয়ে যাবার আর শোষিত হবার সম্ভাবনা যথাক্রমে |a|^2 আর |b|^2 হবে (|a|^2 + |b|^2 = 1 ধরে নিলে) সেটা একটু ভালো করে বোঝা দরকার। যদি অনেক অনেক ফোটনকে এই একই দশায় তৈরি করে তাদের সবাইকে X অক্ষ ওয়ালা পোলারয়েড কাগজ দিয়ে পাঠানো হয়, তাহলে তাদের মধ্যে প্রায় |a|^2 অংশ পেরিয়ে যাবে, আর 1- |a|^2 = |b|^2 অংশ শোষিত হবে।

 

কিন্তু একই ফোটনকে যদি অনেকগুলো X অক্ষওয়ালা পোলারয়েড কাগজ দিয়ে পাঠানো হয়, তাহলে কিন্তু এই সম্ভাবনার অংক খাটবে না। যদি ফোটনটা প্রথম কাগজ দিয়ে না বেরোয়, তাহলে তো সেখানেই গল্প শেষ। কিন্তু যদি সেটা প্রথম পোলারয়েড পেরিয়ে যায়, তাহলে কিন্তু তারপর প্রত্যেকটা দিয়েই পেরিয়ে যাবে! এটা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আরেকটা বড়ো শিক্ষা – X-পোলারয়েড দিয়ে বেরোনোর ফলে ফোটনের দশা পালটে যায় – সেটা আর a|0> +b |1> দশায় থাকে না – তার দশা |0> হয়ে যায়। এটাও আলোর পোলারাইজেশন থেকে চেনা – একবার X-পোলারয়েডের মধ্যে থেকে বেরোলে আলো আর ৪৫ ডিগ্রি কোণে পোলারাইজড থাকে না – সেটা X অক্ষ বরাবর পোলারাইজড হয়ে যায়।

 

এটা হয়তো তোমরা বুঝেই গেছো, তবু বলছি যে পোলারয়েডের অক্ষটা যদি X অক্ষ বরাবর না রেখে সেটাকে + ৪৫ ডিগ্রি কোণে রাখা হয়, তাহলে |0> দশায় ফোটন এসে পড়লে সেটা পেরোনোর সম্ভাবনা ৫০%। কিন্তু যদি যে ফোটনটা এসে পড়ছে তার দশা (|0> +|1>)/√2 হয় তাহলে সেটা এই পোলারয়েডকে পেরিয়ে যাবেই। অন্যদিকে ফোটনের দশা (|0> – |1>)/√2 হলে সেটা আটকে যাবেই!

 

যে কথাটা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো যে একটা কিউবিট শুধু দুটো দশায় নয় – অসংখ্য দশার মধ্যে যে কোনো একটিতে থাকতে পারে। কিউবিটের এই অসংখ্য দশায় থাকতে পারার জন্যই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পক্ষে কিছুক্ষেত্রে সাধারণ কম্পিউটারের থেকে বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

 

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seventeen − fifteen =