কোষকলা সংস্থাপনের নতুন কৌশল

কোষকলা সংস্থাপনের নতুন কৌশল

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
‘ইঞ্জিনিয়ারড লিভিং মেটিরিয়ালস’ হল কোষভিত্তিক নরম পদার্থ বানানোর কৌশল। কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখিয়েছেন, কোষ-সমৃদ্ধ জেল যখন জমাট বাঁধতে শুরু করে, তখন সেটিকে হালকা কম্পনে নড়াচড়া করিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী শক্ত বা নরম করা যায়। এই কৌশল জরুরি রক্তক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষত চিকিৎসায় কাজে লাগতে পারে। অন্যদিকে ভবিষ্যতের কোষ কলা সংস্থাপন প্রযুক্তিতেও নতুন পথ খুলে দিতে পারে। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, রাসায়নিক গঠন না বদলিয়ে কেবল যান্ত্রিক কম্পন ব্যবহার করেই পদার্থকে প্রয়োজন অনুযায়ী সাজিয়ে নেওয়া সম্ভব, যা আশপাশের কোষকলাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না। গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন আরাম বাহমানি। গবেষক দল একটি স্পিকার-চালিত মঞ্চ ব্যবহার করে বিভিন্ন কোষ-সমৃদ্ধ জেল জমাট বাঁধার সময়ে নির্দিষ্ট মাত্রার কম্পন প্রয়োগ করেছেন। এই কৌশলটি তারা পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করেছেন একাধিক পরিচিত জেলের উপর। যথা সম্পূর্ণ জমাট বাঁধা রক্ত , প্লাজমা ও ফাইব্রোব্লাস্ট-যুক্ত জেল, এবং অ্যালজিনেট-ভিত্তিক হাইড্রোজেল, যা ক্ষত ঢাকার ড্রেসিং ও কোষকলা প্রযুক্তিতে বহু ব্যবহৃত। দেখা গেছে, কম্পনের বিস্তার (একটি স্থির অবস্থান থেকে তরঙ্গের সর্বোচ্চ দূরত্বের পরিমাপ) ও কম্পাঙ্ক (প্রতি সেকেন্ডে একটি নির্দিষ্ট বিন্দু অতিক্রমকারী দোলনের সংখ্যা) ভিন্ন ভিন্ন সমন্বয় কোষগুলোর ত্রিমাত্রিক অবস্থান বদলে দেয়। কোথাও কোষগুলি গুচ্ছাকারে জমাট বাঁধে, আবার কোথাও ছড়িয়ে যায়। এই সামান্য ভিন্নতা সরাসরি প্রভাব ফেলে বৃহৎ স্তরের বৈশিষ্ট্যেও। যথা জেল-এর দৃঢ়তা ও ভাঙন-প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর। গবেষকরা ফাইব্রিন তন্তুর বিন্যাসের উপর, রক্তের জমাট বাঁধা ডেলা সংকোচনের উপর, এমনকি ইঁদুরের লিভারে ছিদ্র করে তৈরি ক্ষতের উপরেও এই পরীক্ষা চালিয়েছেন। ফলাফল থেকে জানা যায়, কোষ যদি গুচ্ছে জমাট বাঁধে, তবে জেল-এর ভেতরে বড় ফাঁক তৈরি হয়, ফলে ফাটল ধরার পথ সহজ হয়। আর কোষ যদি ছড়িয়ে থাকে, তবে ফাইব্রিন জালিকা ঘন, ছোট ও মজবুত হয়, যা বিকৃতি প্রতিরোধ করে এবং ভাঙনকে ধীর করে। ক্ষত পূরণ করার জন্য জমাট বাঁধা রক্তের ডেলা যথেষ্ট শক্ত হওয়া চাই। দুর্বল ডেলা ভেঙে গেলে টুকরোগুলি ছিঁড়ে বের হয়ে রক্তস্রোতে মিশে যেতে পারে, যা মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। এর আগে জীবন্ত পদার্থ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়েছিল চৌম্বক ক্ষেত্র ও শব্দ -উত্তর তরঙ্গ। এগুলো শক্তিশালী, কিন্তু অনেক সময় অতিরিক্ত তাপ বা ক্ষয়/গর্ত তৈরি করে কোষকলার ক্ষতি করতে পারে। ম্যাকগিলের এই নতুন পদ্ধতিতে সে ঝুঁকি নেই। এখানে হালকা যান্ত্রিক নড়াচড়ার সাহায্যেই কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়। দেখা গেছে, নির্দিষ্ট কম্পনে তৈরি জমাট ডেলা সাধারণ অবস্থার তুলনায় চারগুণ বেশি শক্ত বা নরম হতে পারে। বাহমানি বলছেন, প্রয়োজন অনুযায়ী একেক পরিস্থিতির জন্য একেক বৈশিষ্ট্যের উপাদান বানানো সম্ভব। ইঁদুরের লিভার মডেলে দেখা গেছে, উপযুক্ত কম্পনে তৈরি জমাট ডেলা , নমুনার তুলনায় যথেষ্ট শক্তিশালী হয়েছে, কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই। জরুরি চিকিৎসায় যেখানে রক্তপাত দ্রুত থামানো দরকার, সেখানে এটি বিশেষভাবে উপকারী হতে পারে। আবার যেখানে রক্তডেলা ভেঙে রক্তপ্রবাহ ফিরিয়ে আনা দরকার – যেমন স্ট্রোকের চিকিৎসায় ক্লট-ব্রেকিং থেরাপি – সেখানে নরম বা অবাধ প্রবাহ তৈরি করাও সম্ভব। গবেষকরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তিকে সরাসরি ক্ষত ঢাকার ড্রেসিং বা সার্জিক্যাল সরঞ্জামের মধ্যে যোগ করা যাবে। বিশেষ কোষকলার জন্য প্রয়োজনীয় দৃঢ়তা যুক্ত স্ক্যাফোল্ড জেল তৈরি করতে এটি কাজে লাগানো যাবে। স্ক্যাফোল্ড জেল একটি ত্রিমাত্রিক, জেল সদৃশ উপাদান যা কোষকলা প্রযুক্তি এবং ওষুধ সরবরাহে ব্যবহৃত হয়। এটি প্রাকৃতিক জৈবিক কোষকলার পরিবেশের সদৃশ। বাহমানির ভাষায়, “এই পদ্ধতিকে রোমাঞ্চকর করে তুলেছে এর কম যন্ত্রণাদায়ক বৈশিষ্ট্য, স্বল্প ব্যয়বহুলতা ও সহজ ব্যবহারযোগ্যতা।” এর যন্ত্রপাতিও খুব সহজলভ্য, ফলে বিশেষায়িত ল্যাব ছাড়াই এটি ব্যবহার করার সম্ভাবনা বেশি থাকবে।
সূত্র : Engineering Highly Cellularized Living Materials via Mechanical Agitation by Aram Bahmani, Shiyu Liu, et.al ; Advanced Functional Material (16 July 2025

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three + thirteen =