খাদ্যের স্মৃতি-ছাপ

খাদ্যের স্মৃতি-ছাপ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৬ অক্টোবর, ২০২৫

আমরা কখন খাই আর কতটা খাই – এই দুই বিষয়ই আমাদের শরীরের ওজন ও স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি। খাওয়ার সময় ও পরিমাণ নির্ধারণ করে আমাদের মস্তিষ্ক। সেই রহস্যের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। লস অ্যাঞ্জেলেসের সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা সম্প্রতি এমন একদল নিউরন বা স্নায়ুকোষ চিহ্নিত করেছেন, যা “খাবারের স্মৃতি” ধরে রাখে। এই কোষগুলো জানিয়ে দেয় আমরা কখন, কী ও কতটা খেয়েছি। আর সেই তথ্যের ভিত্তিতেই মস্তিষ্ক সিদ্ধান্ত নেয়, আমাদের আবার কি খাওয়া উচিত বা খাওয়া উচিত নয়।

তাঁরা এই গবেষণাটি করেছেন ল্যাবরেটরির ইঁদুরদের উপর। তারা লক্ষ্য করেন, যখন ইঁদুররা খাবার খায়, তখন মস্তিষ্কের ‘ভেন্ট্রাল হিপোক্যাম্পাস’ নামক অংশের নির্দিষ্ট কিছু নিউরন সক্রিয় হয়ে ওঠে।এই নিউরনগুলো তৈরি করে একধরনের স্মৃতি ছাপ, যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন “এনগ্রাম”। এনগ্রাম হল মস্তিষ্কের ভিতর গঠিত এক ধরনের জৈব ছাপ, যা অভিজ্ঞতার স্মৃতি ধরে রাখে। প্রধান গবেষক স্কট কানস্কি বলেন, “এনগ্রাম আসলে মস্তিষ্কে স্মৃতির পদচিহ্ন। আর খাবার সম্পর্কিত এনগ্রাম হলো এমন এক জৈবিক নথি, যা একসঙ্গে ধরে রাখে, কি খাওয়া হয়েছে, কোথায় খাওয়া হয়েছে এবং কখন।” এই কোষগুলো যখন সক্রিয় থাকে, মস্তিষ্ক তখন খাওয়ার অভিজ্ঞতাকে মনে রাখে। কিন্তু মনোযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলে, যেমন যদি কেউ টিভি দেখতে দেখতে বা ফোনে স্ক্রল করতে করতে খায়, তখন এই এনগ্রামগুলি ঠিকমতো গঠিত হয় না। ফলে মস্তিষ্ক খাবারের স্মৃতি ধরে রাখতে পারে না। আর যদি মস্তিষ্ক খাবারের স্মৃতি না রাখতে পারে, তবে আমরা বুঝতে পারি না আগে কতটা খাওয়া হয়েছে। ফলে মস্তিষ্ক আবার খাওয়ার ইঙ্গিত পাঠায়, শরীরের প্রয়োজন ছাড়াই। এই কারণেই অন্যমনস্ক হয়ে খেলে মানুষ প্রায়ই অজান্তে বেশি ক্যালোরি গ্রহণ করে ফেলে। বিজ্ঞানীরা জানান, এই প্রক্রিয়া শুধু সাধারণ মানুষ নয়,স্মৃতিভ্রংশ বা ডিমেনশিয়া-য় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যেও দেখা যায়। তাদের মস্তিষ্কে খাবারের স্মৃতি দীর্ঘস্থায়ী হয় না, ফলে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণের ভারসাম্য হারিয়ে যায়। পরীক্ষায় দেখা যায়, খাবারের স্মৃতি তৈরি করা নিউরনগুলোর সঙ্গে মস্তিষ্কের ল্যাটারাল হাইপোথ্যালামাস অংশের সরাসরি সংযোগ রয়েছে। এখানে ক্ষুধা ও খাওয়ার ইচ্ছা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই সংযোগটি পরীক্ষার মাধ্যমে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিলে ইঁদুররা কোথায় খাবার আছে তা ভুলে যায় এবং অকারণে খেতে থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তাদের অন্য স্মৃতিগুলো – যেমন পথ মনে রাখা বা শব্দ শনাক্ত করা – একদম ঠিক থাকে। এর অর্থ, এই বিশেষ নিউরনগুলি একান্তভাবে “খাবার সম্পর্কিত স্মৃতি”র সাথেই যুক্ত। কানস্কি আরও বলেন, “আমরা সাধারণত খাদ্য নিয়ন্ত্রণ বলতে বুঝি ক্যালোরি কমানো বা ব্যায়াম বাড়ানো। কিন্তু আমাদের গবেষণা দেখাচ্ছে, খাওয়ার স্মৃতি দৃঢ় রাখা ঠিক ততটাই জরুরি।” অর্থাৎ, কখন, কীভাবে এবং কতখানি খাওয়া হয়েছে তা স্পষ্টভাবে মনে রাখলে শরীরের ক্ষুধা-তৃপ্তি চক্র সুষম থাকে। ফলে অতিরিক্ত খাওয়া বা হঠাৎ ক্ষুধা পাওয়ার সম্ভাবনা কমে। এই ধারণা ভবিষ্যতে স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে এক নতুন পথ খুলে দিতে পারে।খাদ্যের স্মৃতি বাড়াতে মানসিক অনুশীলন, সচেতনভাবে বা মন দিয়ে খাওয়ার পদ্ধতি কার্যকর হতে পারে। যদি মানুষের ক্ষেত্রেও এই “খাবারের স্মৃতি কোষ” কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে ওজন বৃদ্ধি, অতিরিক্ত ক্ষুধা, কিংবা খাদ্যাভ্যাসজনিত রোগ প্রতিরোধে এক বৈপ্লবিক পথ তৈরি হবে।

 

সূত্র : “Ventral hippocampus neurons encode meal-related memory” by Léa Décarie-Spain, Cindy Gu, et.el, 11 June 2025, Nature Communications.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

11 + two =