গণবিলুপ্তির প্রকৃত বিপদ কতটা? 

গণবিলুপ্তির প্রকৃত বিপদ কতটা? 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৫ নভেম্বর, ২০২৫

পৃথিবীতে জীববৈচিত্র্যের ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে বছরের পর বছর ধরেই বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদরা সতর্কবার্তা দিয়ে আসছেন। পৃথিবী নাকি ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির দিকে খুব দ্রুত এগোচ্ছে, অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন এক গবেষণা সেই ভবিষ্যদ্বাণীকে খানিকটা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাঁদের দাবি, পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি যতটা দ্রুত বাড়ছে বলে বলা হচ্ছিল, বাস্তবে তা হচ্ছে না। বরং শত বছর আগে এর গতি অনেক বেশি ছিল, এখন তা ধীরে ধীরে কমছে।

গবেষণায় প্রায় বিশ লাখ প্রজাতির তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যার মধ্যে গত ৫০০ বছরে বিলুপ্ত ৯১২টি প্রজাতির ওপর বিশেষ নজর দেওয়া হয়। দেখা যায়, বেশিরভাগ বিলুপ্তি ঘটেছে দ্বীপবাসী প্রাণীদের মধ্যে—বিশেষ করে শামুকজাতীয় মোলাস্কা ও কিছু মেরুদণ্ডী প্রাণীর। এর প্রধান কারণ মানুষের আনা আক্রমণকারী প্রাণী, যেমন—ইঁদুর, শূকর বা ছাগল, যারা স্থানীয় প্রজাতিকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। বিশেষত হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে এর ভয়াবহ প্রভাব দেখা গেছে।

গবেষক দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন ক্রিস্টেন সাবান ও জন উইন্স। তাঁদের মতে, অতীতের এই বিলুপ্তিগুলোর কারণের সঙ্গে আজকের হুমকির মিল নেই। আজকের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আগে মূল সমস্যা ছিল দ্বীপে আগ্রাসী প্রাণীর আগমন, এখন বড় সমস্যা হলো নির্বিচারে অরণ্যনিধন , নগরায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন। তাই অতীতের তথ্য দিয়ে বর্তমানের ঝুঁকি বুঝতে গেলে বিভ্রান্তি ঘটতে পারে।

গবেষণায় এও দেখা গেছে, বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদগোষ্ঠীর বিলুপ্তির হার এক নয়। অর্থাৎ সব প্রাণী সমানভাবে বিপন্ন নয়। যেমন, মোলাস্কা ও মেরুদণ্ডী প্রাণী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও উদ্ভিদ ও পোকামাকড়দের (আর্থ্রোপোডা গোষ্ঠী) বিলুপ্তি তুলনামূলকভাবে কম।

আবার দ্বীপে আগ্রাসী প্রাণীর আগমন বিলুপ্তির প্রধান কারণ হলেও, মূল ভূখণ্ডে এখন সবচেয়ে বড় বিপদ হলো বাসস্থান হারানো এবং জলাশয়ের দূষণ।

আরও এক বিশেষ ক্ষেত্রে গবেষকরা জানিয়েছেন—এখনও পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ব্যাপক বিলুপ্তি ঘটার সরাসরি প্রমাণ কম। তার মানে এ নয় যে জলবায়ু পরিবর্তন বিপজ্জনক নয়; বরং প্রকৃত প্রভাব হয়তো এখনও পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়নি। সময়ের সঙ্গে উষ্ণতা, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি—সব মিলিয়ে ভবিষ্যতে যেকোনো দিন তা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

আই ইউ সি এন -এর তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে ১.৬ লাখেরও বেশি প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে সবচেয়ে আশার কথা, গবেষণায় দেখা গেছে, বিলুপ্তির হার এখন আর বাড়ছে না। বরং বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে তা কমছে। তাঁরা মনে করেন, এর পেছনে রয়েছে সংরক্ষণ প্রচেষ্টা ও সামান্য হলেও সচেতনতা বৃদ্ধি। জন উইন্স বলেন, মানুষ এখন প্রজাতি রক্ষায় আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। সংরক্ষণ খাতে বিনিয়োগ অনেকটা কার্যকর হয়েছে।

তবুও ক্রিস্টেন সাবান সতর্ক করে বলেছেন, এই গবেষণা কখনোই জীববৈচিত্র্যের সংকটকে ছোট করে দেখার আহ্বান নয়। কারণ পৃথিবীর সকল প্রজাতিই এখনো ব্যাপক ঝুঁকিতে আছে।এটা কখনোই ভাবা যাবে না যে তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ, তাদের বিলুপ্তির ভয় নেই।

তিনি আরও বলেন, যদি আমরা এই পরিস্থিতিকে মহাজাগতিক বিস্ফোরণের মতো একটা অবস্থা ভাবি, তাহলে তা থেকে রেহাই পাওয়া অসম্ভব মনে হবে। বরং আমাদের তথ্যভিত্তিক, বাস্তবসম্মত উপায়ে সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে।

পৃথিবী হয়তো এখনই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নয়, কিন্তু তা বলে বিপদ কেটে যায়নি। কি হবে কি হবে করে আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সতর্কতা, বিজ্ঞাননির্ভর বিশ্বাসযোগ্য নীতি, আর একসঙ্গে কাজ করার মনোভাব। কারণ মানুষই একমাত্র প্রাণী যে চাইলেই পৃথিবীর জীবনধারা অক্ষত রাখতে পারে।

 

 

সূত্র : Unpacking the extinction crisis: rates, patterns and causes of recent extinctions in plants and animals By Kristen E. Saban , John J. Wiens,et.al; published in the journal Proceedings of the Royal Society B: Biological Sciences, (15.10.2025).

https://doi.org/10.1098/rspb.2025.1717

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 + seven =