রাতের নিঝুম অন্ধকারে যখন বালিশে মাথা রাখি,মনে হয় যেন পৃথিবী ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করতেই আলো-ছায়ার ভেলা ভাসে, মনের ভেতর নাচে অদ্ভুত সব দৃশ্য—যেন অচেনা হ্রদের পাশে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন, যদিও বাস্তবে আপনি ঘরের মধ্যেই। এই মুহূর্তেই শুরু হয় ঘুমের পথে আমাদের এক অদ্ভুত, জৈবিক অথচ রহস্যে মোড়া অভিযাত্রা।
মানব মস্তিষ্ক প্রতিদিনই ঘুম ও জাগরণের মধ্যে যাতায়াত করে। ঘুমে প্রবেশ বা সেখান থেকে জেগে ওঠা মোটেই সোজা প্রক্রিয়া নয়। এই মধ্যবর্তী অর্ধচেতন দশা বা “লিমিনাল স্টেট”-এর মধ্যেই ঘটে যায় বহু আশ্চর্য স্নায়বৈজ্ঞানিক ঘটনা। বিজ্ঞানীরা এখন জানাচ্ছেন, এই পরিবর্তনের সূক্ষ্ম ত্রুটিই অনেক সময় অনিদ্রা, ঘুম পক্ষাঘাত বা নিদ্রাভ্রমণের মতো ঘুমজনিত সমস্যার কারণ।
ঘুম শুধু বিশ্রাম নয়; এটি মস্তিষ্ক ও দেহের পুনর্পরিচালনার সময়। ঘুমের জগতে প্রবেশের সময় মস্তিষ্কে ঘটে নানা শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন: রক্তপ্রবাহ কমে, মস্তিষ্কের তরল চলাচল বাড়ে, স্নায়ুকোষগুলো ধীরে ধীরে একসঙ্গে ছন্দবদ্ধভাবে কাজ করতে শুরু করে। চিন্তা ধীরে বিকৃত হয়, মস্তিষ্ক যেন বাস্তবতা থেকে একধাপ সরে যায়।
১৯৩০-এর দশকে আলফ্রেড লি লুমিস প্রথম ইইজি যন্ত্রে ঘুমন্ত মস্তিষ্কের তরঙ্গ রেকর্ড করেন। সেখান থেকেই ঘুমের নেপথ্য বিজ্ঞানের যাত্রার সূচনা। তিনি দেখেন, ঘুম যত গভীর হয়, তরঙ্গ তত ধীর ও শক্তিশালী হয়। পরে ন্যাথানিয়েল ক্লেইটম্যান ও ইউজিন আসেরিনস্কি ঘুমের মধ্যে চোখের তারার দ্রুত ঘোরাফেরার (“র্যাপিড আই মুভমেন্ট” বা আর ই এম) পর্ব আবিষ্কার করেন, যে পর্বে স্বপ্ন সবচেয়ে প্রবল হয়। তার আগে ঘুমকে স্পষ্টভাবে “জাগ্রত” বা “অচেতন” দুই ভাগে দেখা হতো। আধুনিক গবেষণা জানাচ্ছে ঘুম এক অবিচ্ছিন্ন ধারা, এর কোনো স্পষ্ট সীমারেখা নেই। এর মাঝামাঝিও নানা সূক্ষ্ম স্তর আছে।
এই মধ্যবর্তী অবস্থাগুলির মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো “হিপনাগোগিক স্টেট” অর্থাৎ গভীর ঘুমে আচ্ছন্নতা আর স্বপ্ন দেখার ঠিক মাঝের পর্বটা। একে ঘুমের প্রথম ধাপ বলে মনে করা হয়। সালভাদোর দালি ও টমাস এডিসন এই অবস্থাকে সৃজনশীলতার উৎস বলে মানতেন। ২০২১ সালে প্যারিস ব্রেন ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা যায়, মাত্র ১৫ সেকেন্ডের এই পর্ব থেকে জেগে ওঠা মানুষ তিনগুণ বেশি সৃজনশীল হয়ে ওঠে। কারণ এই পর্যায়ে মস্তিষ্ক তার নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে, চিন্তা হয় মুক্ত ও অবাধ।
নিবিড় ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়ার সময় মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে “নিশীথ দশায় ” চলে যায়। প্রথমে হাইপোথ্যালামাস ও থ্যালামাসের কার্যকলাপ কমে, তারপর কর্টেক্সের সামনের অংশ থেকে পেছনের দিকে ধীরে ধীরে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। এই সময় অনেকেই অদ্ভুত দৃশ্য, শব্দ বা স্পর্শ অনুভব করেন। যেন স্বপ্ন ও বাস্তবের মাঝামাঝি এক দুনিয়ায় আছেন।
অন্যদিকে, ঘুম থেকে জেগে ওঠার সময়ও ঘটে আরেক চমক। সুইজারল্যান্ডের অরেলি স্টেফানের গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কে তখন এক বিশেষ ধীর তরঙ্গ দেখা দেয়, যা মানুষকে ধীরে, স্বাভাবিকভাবে জাগিয়ে তোলে।এই তরঙ্গ না থাকলে জাগরণের পর বিভ্রান্তি বা অলসতা দেখা দেয়। তবে মস্তিষ্ক কখনোই একযোগে জাগে না, কখনো তার অংশবিশেষ ঘুমিয়ে থাকতে পারে, যাকে বলা হয় লোকাল স্লিপ। মস্তিষ্কের ক্লান্ত স্নায়ুকোষগুলো তখন বিশ্রাম নেয়, যদিও মানুষ বাহ্যত জেগে থাকে। এই অসম ঘুম ও জাগরণের মিশ্রণ থেকেই দেখা দেয় ঘুমের নানান ব্যাধি।
ঘুম-বিশেষজ্ঞ লরা লুইস বলেন, “এই রোগগুলো মূলত ঘুম ও জাগরণের মাঝে ‘ দশা বদল ’-এর গোলযোগ।“ অর্থাৎ, যখন মস্তিষ্ক ঠিকভাবে এক দশা থেকে অন্য দশায় সরে যেতে পারে না, তখনই দেখা দেয় বিভ্রান্তি, ভয় আর অস্থিরতা।
মস্তিষ্ক আমাদের শরীরে এক জাদুকরের ভূমিকা পালন করে। এক মুহূর্তে সে আমাদের বাস্তবে রাখে, পরমুহূর্তেই টেনে নেয় স্বপ্নের জগতে। আর সেই দুই জগতের মাঝখানেই, নীরবে প্রবাহিত হয় আমাদের চেতনা।
সূত্র : How the Brain Moves From Waking Life to Sleep (and Back Again) by Yasemin Saplakoglu, published in QuantaMagazine,(17.10.2025).
