
ঘুমের প্রয়োজনীয়তা অনেকদিনের এক রহস্য। কারণ মস্তিষ্কে এমন কোনো সুনির্দিষ্ট সংকেত পাওয়া যায়নি যা জানায় ‘এবার ঘুম দরকার’। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুম শুরু হওয়ার সংকেত আসে কোষের শক্তিকেন্দ্র মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জেরো মিয়েসেনবক এবং তাঁর দল ফল মাছির ওপর গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন, দীর্ঘ সময় জেগে থাকার পর নিউরনের মাইটোকন্ড্রিয়ায় অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়ে। অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়ার অর্থ মুক্ত রেডিক্যাল আর অ্যান্টি-অক্সিডান্টের ভারসাম্য বিচলিত হওয়া। বিশেষত, ফলমাছির মস্তিষ্কপৃষ্ঠর একটি স্নায়ুগঠন, যেখানে ঘুম-প্ররোচক নিউরন থাকে, সেখানে মাইটোকন্ড্রিয়ার শ্বাস প্রশ্বাস বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ইলেকট্রন পরিবহন সৃঙখল থেকে অতিসক্রিয় অক্সিজেন রাসায়নিক অণু নির্গত হয়। এই অণু কোষঝিল্লির লিপিডকে জারিত করে। যখন তা ক্রান্তি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন ঘুম শুরু হয়। ঘুমের সময় মাইটোকন্ড্রিয়ার গঠন ও কার্যকারিতা দ্রুত পুনরায় ঠিক হয়। অর্থাৎ ঘুম মূলত কোষের পুনঃস্থাপন ও মেরামতের প্রক্রিয়া। গবেষকরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে মাছিগুলোকে জাগিয়ে রাখেন, যেমন হালকা কম্পন কিংবা উত্তেজক নিউরনকে উত্তপ্ত করা। সব পদ্ধতিতে একই ধরনের মাইটোকন্ড্রিয়াল অক্সিডেটিভ সংকেত পাওয়া গেছে। এটিই হল ঘুমের প্রয়োজনীয়তার জৈব-রাসায়নিক চিহ্ন। গবেষণায় দেখা গেছে, যদি মাইটোকন্ড্রিয়ার সংযোজন (ফিউশন) বাধাগ্রস্ত হয়, মাছিগুলো কম ঘুমায় এবং ঘুমের ফলে পুরোনো অবস্থায় ফিরে যাওয়াও ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে, জেনেটিক বা অপ্টোজেনেটিক পদ্ধতিতে মাইটোকন্ড্রিয়াল সংযোজন বাড়ালে ঘুমের পরিমাণ ও পুরোনো অবস্থায় ফিরে যাওয়া দুটোই বৃদ্ধি পায়। একটি পরীক্ষায় মাইটোকন্ড্রিয়ার মধ্যে আলো দিয়ে চালিত প্রোটন পাম্প সংযোজন করে মাত্র এক ঘণ্টা সবুজ আলোয় রাখলে ঘুমের পরিমাণ ২৫% বেড়ে যায়। মাইটোকন্ড্রিয়াল রেডক্স সংকেত ঘুমের জন্য একটি জৈব ঘড়ির মতো কাজ করে। এর আগে ইদুরের মডেলেও দেখা গিয়েছিল, অতি সক্রিয় অক্সিজেন অণু জমে গেলে কোষের কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা ঘুম কমায়। ঘুম লিপিড ফসফাটিডিক অ্যাসিডের মাত্রা বজায় রাখে। এটি মাইটোকন্ড্রিয়াল সংয়োজন-বিদারণ (ফিশন ) প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে ঘুমের স্থায়িত্ব বাড়ায়। মাইটোকন্ড্রিয়ার সংয়োজন ও বিদারণ বিপরীতমুখী দুটি প্রক্রিয়া, যা মাইটোকন্ড্রিয়ার গঠন ও কার্যকারিতাকে গতিশীলভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। সংয়োজন মানে দুটি মাইটোকন্ড্রিয়ার একত্র মিলন, আর বিদারণ মানে একটি মাইটোকন্ড্রিয়া ভেঙে দুই ভাগে বিভক্ত হওয়া। এই দুটি প্রক্রিয়া সুস্থ মাইটোকন্ড্রিয়া বজায় রাখতে, কোষীয় সম্পদ সঠিকভাবে বণ্টন করতে এবং কোষীয় চাপের প্রতিক্রিয়ায় সাড়া দেওয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষের মাইটোকন্ড্রিয়াল প্রোটিনের সঙ্গে ফলমাছির মিল থাকায় এই গবেষণা ঘুম সংক্রান্ত নতুন চিকিৎসার পথ খুলে দিতে পারে। প্রাইমারি মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে অতিরিক্ত ক্লান্তি এক সাধারণ উপসর্গ। এই গবেষণা ঘুমকে শুধু বিশ্রামের প্রক্রিয়া হিসেবে নয়, বরং কোষের সক্রিয় পুনর্গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হিসেবে দেখায়।
তথ্যসূত্র : Mitochondrial origins of the pressure to sleep,
Raffaele Sarnataro, et. al ; Nature(16 July, 2025)