চাঁদের গুহায় ঘাঁটি নির্মাণ করার চিন্তাভাবনা করছে চীন

চাঁদের গুহায় ঘাঁটি নির্মাণ করার চিন্তাভাবনা করছে চীন

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

গুহা ছিল মানুষের প্রথম আশ্রয়স্থল। গুহা আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষদের প্রকৃতির রুদ্র রূপ থেকে, শিকারী বন্য প্রাণীদের থেকে এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে রক্ষা করেছিল। সে সময় লাঠি, পাথর, পশম এবং আগুন ছিল তাদের একমাত্র প্রযুক্তি। আদিম মানুষ এবং আমাদের মধ্যে আজ একটা কাব্যিক সমান্তরাল আছে। মানুষ আবার চাঁদে যাচ্ছে, তারা মনে করছে চাঁদের গুহা তাদের আশ্রয় দিতে পারে, ঠিক যেভাবে গুহা মানুষের পূর্বপুরুষদের পৃথিবীতে আশ্রয় দিয়েছিল। চাঁদে, মহাকাশচারীদের বিভিন্ন ধরনের বিপদ থেকে সুরক্ষার প্রয়োজন হবে। তাদের মহাজাগতিক এবং সৌর বিকিরণ, উল্কাপিণ্ড, তাপমাত্রার প্রবল হেরফের এমনকি ইজেক্টের প্রভাবের সাথে লড়াই করতে হবে।
Lunar Reconnaissance Orbiter (LRO) শত শত ‘স্কাইলাইট’ খুঁজে পেয়েছে, যেখানে একটি লাভা টিউবের উপরের ছাদ ধসে পড়ে, টিউবের মুখে খুলে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন চাঁদে কয়েকশ মিটার ব্যাসের লাভা টিউব থাকতে পারে যা মহাকাশচারীদের প্রয়োজনীয় আশ্রয় প্রদান করতে পারে। চাঁদের লাভা টিউবের ভিতরে নভোচারীরা ওপরের মোটা শিলার ছাদের মাধ্যমে অতিরিক্ত সুরক্ষা লাভ করবে। লাভা টিউবগুলোকে পাইরোডাক্টও বলা হয়। চাঁদের পৃষ্ঠের উপর দিয়ে প্রবাহিত লাভা যখন শীতল হতে শুরু করে তখন সেই লাভা টিউব তৈরি হয়েছিল। প্রবাহিত লাভার উপরের অংশটি একটি শক্ত আস্তরণ তৈরি করেছিল, কিন্তু গলিত লাভা টিউব দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে এবং অবশেষে লাভা বয়ে যাওয়ার পরে একটি খালি নল পড়ে থাকে। আমাদের পৃথিবীতেও এই লাভা টিউব দেখা যায়। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন কবে চন্দ্রের এই অগ্নুৎপাত বন্ধ হয়েছিল, হয়তো তা এক বিলিয়ন বছর আগে ছিল, যদিও কিছু প্রমাণ থেকে জানা গেছে যে গত ৫০ মিলিয়ন বছরে ছোটোখাটো ঘটনা ঘটেছিল। উভয় ক্ষেত্রেই, এই লাভা টিউবগুলো প্রাচীন এবং অক্ষত।
চাঁদে, নভোচারীদের তাপমাত্রার এই বিশাল পরিবর্তনের সাথে লড়াই করতে হবে। চাঁদের এক দিক অর্ধেক সময় সূর্যের সরাসরি আলো পায় এবং সেখানে পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছায় আর যে দিকটি অন্ধকারে ঢেকে থাকে সেখানে তাপমাত্রা -১৭৩ °সে অবধি হতে পারে। তাপমাত্রার এই বিস্তার ফারাক চন্দ্রপৃষ্ঠে কাজ করা, যন্ত্রপাতি প্রকৌশলী ও নির্মাণ করা চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। বিজ্ঞানীদের মতে লাভা টিউবে প্রাকৃতিকভাবে স্থিতিশীল তাপমাত্রার পরিবেশ পাওয়া যাবে যা চাঁদে অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। চন্দ্র পৃষ্ঠে বিকিরণও বিপজ্জনক। এটি পৃথিবীর পৃষ্ঠের তুলনায় ১৫০ গুণ বেশি শক্তিশালী হতে পারে। লাভা টিউব সেক্ষেত্রেও তাদের সুরক্ষা প্রদানের করবে।
বিভিন্ন দেশ এবং সংস্থার বিজ্ঞানীদের দল লাভা টিউবকে আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করার ধারণা নিয়ে গবেষণা করেছে। চীন এখন ধারণাটি বিবেচনা করছে। চীনে সাম্প্রতিক একটি সম্মেলনে, সাংহাই একাডেমি অফ স্পেসফ্লাইট টেকনোলজির ঝাং চংফেং এক গবেষণা উপস্থাপনা করেন যেখানে গবেষকরা চাঁদের লাভা টিউব কীভাবে ব্যবহার করবেন তা বোঝার জন্য চীনের লাভা টিউবগুলো নিয়ে কাজ করেন। ঝাং-এর মতে, চাঁদ এবং পৃথিবীর লাভা টিউবের মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে। চীন অনুসন্ধানের জন্য মেয়ার ট্রানকুইলিটাটিস (সি অফ ট্র্যাঙ্কুলিটি) এবং মেয়ার ফেকুন্ডিটাটিস (সি অফ ফেকুন্ডিটি)- এর লাভা টিউবকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। চীন একটি রোবোটিক সিস্টেমের পরিকল্পনা করছে যা মেয়ার ট্রানকুইলিটাটিসের গুহাগুলো অন্বেষণ করতে পারে। অনুসন্ধানের জন্য প্রাইমারি প্রোবে চাকা বা পা থাকবে এবং এটি সেখানকার ভূখণ্ডের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য এবং বাধাগুলি অতিক্রম করার জন্য নির্মিত হবে। এটিতে একটি বৈজ্ঞানিক পেলোডও থাকবে।
চীন এই ধারণা সম্পূর্ণ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে মনে হচ্ছে। হুয়াজং ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী ডিং লিয়ুন, চায়না সায়েন্স ডেইলিকে বলেছেন যে অবশেষে, পৃথিবীর বাইরে বাসস্থান তৈরি করা শুধুমাত্র মহাকাশ অনুসন্ধানের জন্য বা সমস্ত মানবজাতির অনুসন্ধানের জন্য নয়, মহাকাশ শক্তি হিসাবে চীনের কৌশলগত চাহিদাগুলির জন্যও অপরিহার্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × 1 =