
দর্শন আর বিজ্ঞান, দুই ক্ষেত্রেই দীর্ঘকালের এক মৌলিক প্রশ্ন – চেতনার উদ্ভব কিভাবে হল? মানুষ কেন এবং কিভাবে আবেগ, আত্মসচেতনতা, অনুশীলনযোগ্য স্মৃতি, পরিকল্পনা—এসব গুণাবলী লাভ করল? সাধারণত মস্তিষ্ক- বল্কল বা কর্টেক্সকেই এর আধার বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু এখন নতুন একটি পর্যালোচনা বলছে, আমাদের চালচলন এবং অভিজ্ঞতা শুধু কর্টেক্স থেকে উদ্ভূত নয়। এগুলি মস্তিষ্কর আরো পুরোনো এবং মৌলিক অংশগুলোর সক্রিয়তার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত । কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিটার কপোল্লা এ বিষয়ে একটি পর্যালোচনা করেছেন। গত কয়েক দশক ধরে নিউরোইমেজিং, প্রাণী গবেষণা, উদ্দীপনা পরীক্ষা ও মস্তিষ্কের আঘাত সংক্রান্ত ক্লিনিক্যাল প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, মানুষের পূর্বসূরী প্রাণী, যেমন সরীসৃপ, মাছ, এমনকি স্তন্যপায়ী জীবেও চেতনা থেকে থাকতে পারে।
মস্তিষ্কের বাইরের আচ্ছাদন বা কর্টেক্সকেই চেতনার মূল আধার হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু কপোল্লার পর্যলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, কর্টেক্স অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সাবকর্টেক্সও এমন কিছু মৌলিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করে যা বিভিন্ন অনুভূতির জন্ম দেয়। যেমন খিদে, ভয়, দুঃখ, আনন্দ। উদ্দীপনা পরীক্ষা বলছে, কর্টেক্সে পরিবর্তন ঘটলে ব্যক্তি বা প্রাণীর স্ব-চেতনা ও কল্পনার অভিজ্ঞতা বদলাতে পারে। কিন্তু সাবকর্টেক্সকে প্রভাবিত করলে মৃত্যু, অচেতন অবস্থা, বা গভীর মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন, এসব ঘটতে পারে।এক ধরণের রোগে কিছু শিশু প্রায় পুরো কর্টেক্স ছাড়াই জন্ম নেয়। তথাপি, তারা সঙ্গীত পছন্দ করতে পারে, মানুষকে চিনতে পারে, এবং অনুভব করতে পারে আনন্দ বা বিরক্তি। প্রাণী গবেষণায় দেখা গেছে, কর্টেক্স অপসারণের পর অনেক মেরুদণ্ডী স্তন্যপায়ী প্রাণী তাদের পারিবারিক কাজ, পরিচর্যা, খেলাধুলা ও অন্য কিছু জটিল আচরণ বজায় রাখতে পারে। বর্তমানে, চিকিৎসাবিদরা বেশিরভাগই কর্টেক্সের কার্যকলাপ দেখে নির্ধারণ করেন কোনো রোগী চেতনাশীল কি না। কিন্তু এই নতুন ধারণা বলছে, সাবকর্টেক্সের পরিস্থিতিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। রোগীর কর্টেক্স প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সাবকর্টেক্স সক্রিয় থাকলে হয়তো কিছু মৌলিক অনুভব ও সচেতন অবস্থা থাকতে পারে। বর্তমান পদ্ধতিতে এগুলো উপেক্ষিত। কপোল্লার কাজ মনে করিয়ে দিচ্ছে, মানব আর অন্য প্রাণীর চেতনার পার্থক্য হয়তো অতীব মৌলিক নয়। কর্টেক্স মানুষের উচ্চস্তরের ভাষাগত দক্ষতা, পরিকল্পনা, গল্প বলার ক্ষমতা, স্ব-পরিচয়ের মতো বৈশিষ্ট্য বাড়িয়ে দেয় ঠিকই; তবে সেই সব হয়তো একটি গভীর, পুরোনো চেতনার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। মস্তিষ্কে আঘাত বা অবধান-ক্ষীণতার রোগীদের ক্ষেত্রে সাবকর্টেক্সের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা জরুরি। যদি সেখানে কিছু অনুভব থাকে, তাহলে রোগীর যত্ন বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নৈতিক বিষয়গুলি ভিন্ন হতে পারে। অন্যদিকে প্রাণী অধিকার, পশু গবেষণায় ব্যবহার ইত্যাদিতে চেতনা কোন মাত্রায় আছে—এই প্রশ্নেও নতুন আলো পড়তে পারে। তাছাড়া উন্নত ইমেজিং পদ্ধতি, স্নায়বিক উদ্দীপনা, প্রাণী মডেল, সব মিলিয়ে বোঝা যাবে চেতনার শুরু কোথা থেকে, কেমনভাবে তা বিকশিত হয়, কি কি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উপাদান সেই বিকাশে ভূমিকা পালন করে।
কপোল্লার পর্যলোচনা চেতনার উৎস ও প্রকৃতি সম্পর্কে একটি অধিক গতিশীল ও বিস্তৃত ধারণা দেয়। চেতনাকে শুধুমাত্র কর্টেক্সের উপর আধারিত বললে হয়তো পুরো সত্যিটা ধরা পড়বে না। তার বিকল্প হিসেবে ভাবা যেতে পারে, সাবকর্টেক্সের অংশগ্রহণ, যা সচেতনার পুরোনো ভিত্তি তৈরি করেছে আর সেটা মানুষের চেতনার উচ্চমাত্রার কাঠামো গঠনে সহায়ক হয়েছে। এভাবে বিজ্ঞান, দর্শন ও নীতিশাস্ত্রর মধ্যে এক নতুন সেতুবন্ধন গড়ে উঠতে পারে। সেখানে চেতনা ” মানুষেরই একক বৈশিষ্ট্য নয়”, বরং জীবজগতের ইতিহাস ও বিবর্তনের এক গভীর প্রকাশ।
সূত্র: Neuroscience & Biobehavioral Reviews
Volume 177, October 2025, 106333