জাগুয়ারের দীর্ঘ সাঁতার

জাগুয়ারের দীর্ঘ সাঁতার

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

জাগুয়াররা যে দক্ষ সাঁতারু, তা জানা ছিল। কিন্তু ব্রাজিলের সের্রা দা মেসা জলাধারে যা ঘটল, তা সব কল্পনাকে ছাড়িয়ে গেছে। ক্যামেরায় ধরা পড়ে এক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ জাগুয়ার, যে একটানা অন্তত ১.২৭ কিলোমিটার খোলা জলে সাঁতরে গেল। যদি মাঝখানে ছোট দ্বীপে না থেমে সরাসরি সাঁতরে থাকে, তবে দূরত্ব দাঁড়ায় প্রায় ২.৩ কিলোমিটার। এর আগে জাগুয়ারের দীর্ঘতম সাঁতারের রেকর্ড ছিল মাত্র ২০০ মিটার। যা এই অভিযাত্রায় চূর্ণ হলো।
এই জাগুয়ারটিকে প্রথমবার দেখা গিয়েছিল ২০২০ সালে মূল ভূখণ্ডে। চার বছর পর আবার ক্যামেরায় ধরা দেয়, তবে এবার একটি বনভূমি-ঘেরা দ্বীপে। এর অনন্য চামড়ার নকশাই প্রমাণ করে এটি সেই একই প্রাণী। গবেষক লিয়ান্দ্রো সিলভেইরা জানালেন, তাঁরা অনুমান করেছেন যে, জাগুয়ারটি হয়তো মাঝপথে কোনো ছোট দ্বীপে থেমেছিল। আর যদি সত্যিই সরাসরি সাঁতরে থাকে, তবে এটি অবিশ্বাস্য এক দৃষ্টান্ত।
আগে মনে করা হতো, জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধ দেওয়া জলাধারগুলো বড় বড় শিকারি প্রাণীর জন্য অনতিক্রম্য প্রাচীর। তাই এক কিলোমিটারের বেশি দূরের দ্বীপগুলো তাদের নাগালের বাইরে। কিন্তু এই ঘটনা প্রমাণ করল, সঠিক পরিবেশ ও অনুকূল জল থাকলে জাগুয়াররা সেই সীমা ভাঙতেও সক্ষম। উষ্ণ জল, শান্ত পরিবেশ থাকলে তারা সহজেই বাধা অতিক্রম করতে পারে – মাঝেমধ্যে ছোট দ্বীপ থাকলেও।
জাগুয়াররা একাই নয়, আফ্রিকার উগান্ডায় সিংহরা বিপরীত পাড় থেকে তাদের সঙ্গীর ডাক শুনে এক কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব সাঁতরে গেছে, এমন নজিরও আছে। আবার ,আমেরিকার ওয়াশিংটনে কুগাররা ঠান্ডা ও খরস্রোত জলাধার পেরিয়ে দ্বীপে পৌঁছেছে। বোঝা যায়, বেঁচে থাকা, প্রজনন বা এলাকা দখলের লড়াইয়ে বড় শিকারিরা জীবন বাজি রাখতেও দ্বিধা বোধ করে না।
জাগুয়াররা বরাবরই সু-অভিযোজনক্ষম প্রাণী। কেউ বাস করে আমাজনের প্লাবনভূমিতে, কেউ টিকে থাকে শুষ্ক কাতিঙ্গা অঞ্চলে। জিপিএস গবেষণা দেখিয়েছে, এক মাসে তারা ১২০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ অতিক্রম করতে পারে, এমনকি মনুষ্য প্রভাবিত এলাকাতেও। আর এবার প্রমাণ মিলল, তারা জলের বিশাল প্রাচীরও জয় করতে পারে।
গবেষকরা এখন অতিক্রান্ত জলপথকে তিন ভাগে ভাগ করছেন—
১) ৩০০ মিটারের কম হলে কম পরিসরের সাঁতার।
২) ১ কিলোমিটার পর্যন্ত মাঝেমধ্যে দ্বীপ থাকলে মধ্যম পরিসরের।
৩) আর এক কিলোমিটারের বেশি দ্বীপ ছাড়া হলে বৃহৎ পরিসরের ।
সের্রা দা মেসার এই রেকর্ড বৃহৎ পরিসরের মধ্যে পড়ে। জাগুয়ার সেই দূরত্ব জয় করেছে। ফলত জল সবসময় বাধা নয়, কখনো কখনো তা সেতু হিসেবেও কাজ করে।
তবে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে ২৫,০০০ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি বনভূমি ডুবে গেছে, যেখানে জাগুয়ারদের আবাস ছিল। এর ফলে দ্বীপগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং অনেক জায়গায় এই শিকারি প্রাণীরা হারিয়ে যায়। ভেনেজুয়েলার গুরি জলাধারে এমন পরিস্থিতিতেই শীর্ষ শিকারির বিলুপ্তি ঘটে। কিন্তু ব্রাজিলের এই ঘটনা প্রমাণ করল, সঠিক পরিবেশ-পরিস্থিতি পেলে জাগুয়াররা বিচ্ছিন্ন দ্বীপেও পৌঁছাতে পারে।
অর্থাৎ যা বোঝা গেল প্রকৃতিকে সঠিকভাবে রক্ষা করলে জাগুয়াররা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মধ্যেও সংযোগ স্থাপন করতে পারে। তীরবর্তী বন রক্ষা, প্রাকৃতিক তটরেখা বজায় রাখা আর ছোট দ্বীপগুলোকে সুরক্ষিত রাখাই হতে পারে তাদের ভবিষ্যতে টিকে থাকার সেতুবন্ধ।

জাগুয়ারদের সাঁতার শুধু একটি দৃষ্টান্তই নয়, এটি তাদের অভিযোজনের এবং সাহসী প্রকৃতির অন্যতম প্রতিচ্ছবি। খণ্ডিত আবাসভূমির মাঝেও জীবনের পথ খুঁজে নেওয়া সম্ভব, যদি আমরা প্রকৃতিকে সেই সুযোগ দিই তবেই।

সূত্র: Kilometre-scale jaguar swimming reveals permeable hydropower barriers: implications for conservation in the Cerrado hotspot by Leandro Silveira , et.al ; BiorXiv (doi: https://doi.org/10.1101/2025.09.05.674446)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

sixteen − 8 =