জিন নয়, হরমোনই লিঙ্গ নির্ধারণের নতুন ফর্মুলা !

জিন নয়, হরমোনই লিঙ্গ নির্ধারণের নতুন ফর্মুলা !

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৭ জুন, ২০২৫

প্ল্যাটিপাস আর একিডনা দেখতে অদ্ভুত। চলাফেরাতেও একটির সাথে অপরটির কোন মিল নেই। তবে তাদের শরীরের ভিতরে লুকিয়ে আছে বড় বিস্ময়! এই দুই প্রাণী হল মনোট্রিম শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, অর্থাৎ এমন একদল স্তন্যপায়ী যারা ডিম পাড়ে। কিন্তু এই আলোচনার বিষয় সেটা নয় বরং এদের গোপন লিঙ্গ নির্ধারণ পদ্ধতি। এক্ষেত্রেও বাকি স্তন্যপায়ীদের থেকে এটি একেবারে আলাদা। অধিকাংশ স্তন্যপায়ীর (যেমন মানুষ, কুকুর, বিড়াল) মধ্যে Y ক্রোমোজোমে থাকা SRY নামক একটি জিন পুরুষত্ব নির্ধারণ করে। এই SRY জিনের মাধ্যমে শরীরে টেস্টিস তৈরি শুরু হয় এবং পুরুষ বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন দেখিয়েছেন, প্ল্যাটিপাস আর একিডনার মধ্যে SRY জিন নেই! তাহলে কীভাবে এদের নারী- পুরুষ বিভাজন করা হয়? প্ল্যাটিপাস পুরুষদের শরীরে রয়েছে ৫টি X এবং ৫টি Y ক্রোমোজোম, যা শুক্রাণু তৈরির সময় জুড়ে যায় এক অদ্ভুত ক্রমে। দেখতে হয় যেন জিনের মালার মতন। নারীরা কেবল পাঁচটি X জোড়া নিয়েই দিব্যি টিকে থাকে। বিজ্ঞানীরা হতবাক হলেও, প্রকৃতি স্পষ্ট বলছে, জটিলতা মানেই ভঙ্গুরতা নয়। জিনোম ঘড়ি বলছে, মনোট্রিমরা বাকি স্তন্যপায়ীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে প্রায় ১৮.৭ কোটি বছর আগে। অতএব, এদের পুরুষত্বের চাবিকাঠি SRY নয়। সেসময়ই জন্ম নেয় বিকল্প পথ-AMHY। সাধারণত anti-Mullerian hormone (AMH) পুরুষ ভ্রূণে, নারী জননতন্ত্রের বিকাশ থামিয়ে দেয় এবং পরে মহিলাদের ডিম্বাণু বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। এরা অপেক্ষাকৃত নীচের সারির খেলোয়াড়। তবে মনোট্রিমদের মধ্যে, বিবর্তন এক কপি AMH-কে বসিয়ে দেয় Y ক্রোমোজোমে। নাম হয় -AMHY. আর তাকেই দিয়ে দেয় এমন নিয়ন্ত্রণ কাঠামো, যা সরাসরি পুরুষত্বের যাত্রা শুরু করে। এই AMHY কাজ করে নিউক্লিয়াসের বাইরে। এরা ডিএনএ চালায় না বরং সংকেত পাঠিয়ে কাজ মেটায়। এটি একমাত্র স্তন্যপায়ী উদাহরণ, যেখানে জিন পড়ার সুইচ অন বা অফের বদলে এক গোপন প্রোটিন-ই চালায় লিঙ্গ নির্ধারণের শুরুটা। AMHY-এর গঠন ও ক্রিয়ার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এটি তার পুরোনো আত্মীয় AMHX-এর সঙ্গে ৫২% ক্ষেত্রে মিল রাখে। পরিবর্তন আসে হরমোন ছাঁটাইয়ের জায়গায় এবং সাংকেতিক এলাকায়। এমনকি নিয়ন্ত্রণকারী বা উদ্ভাবক এলাকাও আলাদা। সেখানে SOX9 বা SF-1 নেই, বরং আছে DMRT1 ও GATA1, যা শুধু পুরুষ গোনাডে সক্রিয়।এমনকি অন্যান্য প্রাণী যেমন পাতাগোনিয়ার মাছ বা কিছু উভচর প্রাণীর ক্ষেত্রেও কখনও কখনও SRY-এর জায়গা দখল করে ফেলেছে, AMH-এর কপি । এ যেন বিবর্তনের লিঙ্গ-রাজনীতির এক নিঃশব্দ বিদ্রোহ! আজ যখন প্ল্যাটিপাস বিলুপ্তির পথে, আর ডিম ফুটে বের হওয়া বাচ্চা সংরক্ষণকারীদের ঘুম ওড়াতে বেসেছে তখন এই AMHY হতে পারে ভবিষ্যতের চাবিকাঠি! অতি প্রারম্ভিক পর্যায়েই লিঙ্গ নির্ধারণের এক সুবর্ণ সুযোগ! শুধু তাই নয়, মানুষের মধ্যে সন্তানধারণ ক্ষমতা বা ঋতুনিবৃতির ভবিষ্যদ্বাণী করতেও সহায়ক হতে পারে এই হরমোনের অজানা রূপ! মনোট্রিমরা আমাদের শেখায় লিঙ্গ কোনো একরৈখিক সত্তা নয়। এটা বিবর্তনের পরীক্ষাগারে চলা এক চিরন্তন নিয়ম বদলানোর খেলা, কিন্তু জীবন থেমে থাকে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

17 + thirteen =