জেনে শুনে বিষ খাওয়া

জেনে শুনে বিষ খাওয়া

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১১ মে, ২০২৫

যা খাই তাই কি খাদ্য? উত্তর হল, না, সেগুলো আহার্য্সামগ্রী। খাদ্য হল সেই উপাদান যা একটি জীবের দৈহিক কার্যের জন্য প্রয়োজনীয় এবং যা দেহের বৃদ্ধি , শক্তি ও পুষ্টি প্রদানে সহায়তা করে। জিভকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে আমরা প্রায়ই দেহকে ব্যস্ত করে ফেলছি ভুল খাদ্য বেছে নিয়ে, তার ফলে নিজেদের অজান্তেই নিত্য সঙ্গী করে ফেলছি কত শত রোগকে। বাজারে চলতি প্যাকেটজাত খাবারগুলি আমাদের স্বাস্থ্যহানির অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন ডাক্তার ও বিজ্ঞানীরা। সবচেয়ে প্রচলিত প্রক্রিয়াজাত খাবারের মধ্যে সাধারণত যেগুলো আছে তা হল, বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত রুটি, মিষ্টিযুক্ত পানীয়, আলুর চিপস, চকোলেট,মিষ্টি, ক্যান্ডি, প্যাকেটজাত কুকিজ ইত্যাদি।

চীনের গুয়াংজুর সান ইয়াত-সেন মেমোরিয়াল হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের পরিচালক জিয়াও লিউ বলেন, “অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবারে উচ্চ চিনি, উচ্চ লবণ এবং অন্যান্য উপাদান রয়েছে, যাতে পুষ্টির ঘনত্ব কম এবং উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত উপাদান বেশি। “এই পণ্যগুলি রক্তের লিপিড প্রোফাইলের নিয়ন্ত্রণহীনতা, অন্ত্রে অণু জীব ঘটিত সংক্রমণ, স্থূলত্ব বৃদ্ধি , অন্ত্রের প্রদাহ, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বা শরীরে ফ্রী র‍্যাডিক্যাল ও অ্যান্টিঅক্সিডেণ্টের ভারসাম্য হ্রাসের তীব্রতা এবং ইনসুলিন হরমোনের ক্ষরণগত গোলযোগ সহ একাধিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্যের পক্ষে প্রতিকূল ফল উৎ পাদন করতে পারে।“

পদ্ধতিগত পর্যালোচনার ভিত্তিতে আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া এবং ওশিয়ানিয়া জুড়ে ৪১টি সম্ভাব্য পর্যবেক্ষণ মূলক অধ্যয়ন করা হয়েছিল। তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিল ২০২৪ সালের এপ্রিলের আগে প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং স্বাস্থ্যের ফলাফলের মধ্যে সম্পর্কের মূল্যায়ন । গবেষণায় দেখা যায়, সাধারণ জনসংখ্যার ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী মোট ৮২, ৮৬, ৯৪০ জন প্রাপ্তবয়স্ক রোগী (৩০. ৮% পুরুষ, ৬৯. ২ % মহিলা) বিভিন্ন রোগের সাথে জড়িত।

আরও দেখা গেছে যে , প্রক্রিয়াজাত খাদ্য গ্রহণ উচ্চ রক্তচাপ, হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন জটিল রোগ, ক্যান্সার, হজমের গোলযোগ বাড়ায়। বহুক্ষেত্রে এগুলোই মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল। প্রতিদিন অতিরিক্ত ১০০ গ্রাম প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণের ফলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি ১৪.৫ শতাংশ, হৃৎপিণ্ডর রক্ত বাহ ঘটিত রোগ হওয়ার ঝুঁকি ৫.৯ শতাংশ, ক্যান্সারের ঝুঁকি ১.২ শতাংশ, হজমজনিত রোগের ঝুঁকি ১৯.৫ শতাংশ এবং মৃত্যুর ঝুঁকি ২. ৬ % বেড়ে যায়। গবেষকরা স্থূলত্ব / অতিরিক্ত ওজন, বিপাক জনিত গোলযোগ/ ডায়াবেটিস এবং হতাশা / উদ্বেগের ঝুঁকিও লক্ষ্য করেছেন।

এযাবৎ হওয়া সকল খাদ্যের গুণমান নির্ণয়কারী দলটি খুবই প্রচলিত ‘নোভা’ খাদ্য বিন্যাস পদ্ধ্বতিতে প্রাকৃতিক খাদ্যের সাথে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের গুণমানের তুল্যমূল্য বিচার করে দেখেছেন। দেখা গেছে, এই প্যাকেটজাত খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ বিভিন্ন ধাপে হয়ে থাকে, খাদ্যকে আরও সুস্বাদু করার জন্য বিভিন্ন রঙিন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, আবার তৈরি খাবারগুলিকে ঠাণ্ডায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়। ফলে খাদ্যের গুণমান থাকে না বললেই চলে। কিন্তু জিভ তো এত গবেষণা বোঝে না, সে বিষকেই বেশি অমৃত মনে করে।

গবেষকরা মনে করেন চিকিৎসকদের উচিত সাধারণ মানুষকে , কোন খাদ্যের কি পুষ্টিগত গুণ , কেনই বা আমরা এই প্যাকেটজাত খাবারগুলকে এড়িয়ে চলব ,এতে আমাদের ঠিক কি ধরনের শারীরিক ঝুঁকি হতে পারে ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে সচেতন করা। শুধু চিকিৎসক নয়, এখানে সরকারের ভূমিকাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ । ন্যূনতম গুণমান যুক্ত প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের গুণমান যাতে কিছুটা বাড়ানো যায় সেই নিয়ে খাদ্য দপ্তরকেও সচেতন হতে হবে। তাদের উচিত কৃত্রিম সংযোজকগুলির ব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া ,আর প্যাকেটের ওপর সঠিক লেবেলিং করে কোন উপাদান কত পরিমাণে আছে এবং কোনটার কি ব্যবহার সেগুলো সঠিক ভাবে সকলের সামনে তুলে ধরা। তাহলে হয়তো মানুষের সামান্য হলেও বুঝতে সুবিধা হবে যে সে শরীরকে কি কি দিচ্ছে। এর ফলে আশা করা যায় খাদ্য সচেতনতা একটু হলেও বাড়বে।

যাইহোক, এই অনুসন্ধানগুলি শুধুমাত্র প্রক্রিয়াজাত খাদ্য বর্জনের কথাই বলে না, নিকৃষ্ট মানের খাদ্যের পরিবর্তে কি কি আসলে খাওয়া উচিত তারও সঠিক পথ দেখায়। বিজ্ঞানীদের মতে এই বিষয়টি নিয়ে আরও উচ্চমানের চর্চা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

15 − 15 =