মানুষ তার চারপাশে যা কিছু দেখে, চাঁদ, তারা, গ্রহ, নক্ষত্রপুঞ্জ বা পৃথিবীর বুকে বিচিত্র জড় ও জীবজগৎ, অসংখ্য ধরণের প্রানী ও উদ্ভিদ – এরা কি আজ যেভাবে আছে বরাবর সেভাবেই ছিল, অনড়, অচল, অপরিবর্তনীয় ? অথবা এরা রয়েছে অবিরাম গতির মধ্যে, পরিবর্তনের মধ্যে ? সর্বদাই নতুন কোনো কিছুর জন্ম এবং পুরানো কিছুর মৃত্যু বা অবলুপ্তির মধ্যে ? গতি বা পরিবর্তন যদি দেখাও যায়, তাহলেও সে পরিবর্তন কি শুধুই বাহ্যিক কারণে ঘটে ? যেমন আইজ্যাক নিউটন (১৬৪২ – ১৭২৭) তাঁর বিখ্যাত গতিসূত্রে বলেছিলেন, “বাইরের থেকে প্রযুক্ত বল কোনো বস্তুর অবস্থার পরিবর্তন না ঘটালে, স্থির বস্তু সর্বদাই স্থির অবস্থায় থাকবে এবং চলমান বস্তু সর্বদা সরলরেখায় সমবেগে চলমান থাকবে।” অথবা, বস্তুমাত্রই বিপরীতের ঐক্য এবং বিপরীতগুলির মধ্যে ঐক্য শর্তাধীন, কিন্তু সংগ্রাম অবিরাম এবং সেই সংগ্রামের কারণেই বস্তু অবিরাম পরিবর্তনশীল। সে কারণেই পুরাতনের বিলয় ও নতুনের উদ্ভব ? মানববিস্তার ইতিহাসে এই যে বিতর্ক, সেটা উনবিংশ শতকে কতগুলো যুগান্তকারী আবিষ্কারের ফলে নতুন মাত্রায় উন্নীত হল। প্রথমতঃ দেহকোষের আবিষ্কার। বহু সংখ্যক কোষ বিভাজিত হয়ে এবং বিশেষ গুণ অর্জন করে সমস্ত উদ্ভিদ দেহ ও প্রাণী দেহ গঠন করেছে। এর ফলে যেমন উন্নত ধরণের প্রাণী ও উদ্ভিদের বিকাশ সম্ভব হয়েছে, তেমনই এক ধরণের উদ্ভিদ বা প্রাণী থেকে ভিন্ন ধরণের প্রাণী বা উদ্ভিদে রুপান্তরের সুযোগও থাকছে। দ্বিতীয় বড় আবিষ্কার হল নানা রুপে শক্তির অভিন্নতা। যান্ত্রিক শক্তি, তাপ, রাসায়নিক শক্তি, বৈদ্যুতিক শক্তি ও চৌম্বক শক্তি, এরা সবাই একে অন্যটিতে রূপান্তরিত হতে পারে। অবিরাম গতির মধ্যে রয়েছে যে প্রকৃতি জগত এরা তার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ মাত্র। এবং শেষ পর্যন্ত এল ডারউইনের এই আবিষ্কার যে জীবজগৎ (উদ্ভিদ এবং মানুষ সহ সকল প্রাণী) আমাদের সামনে রয়েছে তারা সবাই হচ্ছে এককোষী জীব থেকে দীর্ঘ বিবর্তন প্রক্রিয়ার ফল। সেই এক কোষী জীবগুলো আবার প্রোটোপ্লাজম বা অ্যালবুমিন জাতীয় পদার্থের অস্তিত্বের বিশেষ ধরণ। এটা এক ধাক্কায় ভেঙে দিল জীব ও জড়ের মধ্যে পার্থক্যের অলঙ্ঘনীয় প্রাচীর। যে সব ভৌত ও রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে জড়বস্তু ভিন্ন ভিন্ন রূপ প্রাপ্ত হয়, সেই সব ভৌত ও রাসায়নিক পরিবর্তনের এক জটিল বিন্যাসেই তা ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে, যাকে আমরা বলি জীবন। জীববিদ্যা শিখতে গেলে ছাত্রদের জড় ও জীবের মধ্যে পার্থক্য এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য দিয়ে শুরু করতে হয়। জ্ঞানার্জনের একটা স্তরে গিয়ে সেই পার্থক্যগুলো মুছে যায়। আজকে অণুজীববিদ্যার (molecular biology) যে বিকাশ ঘটেছে তাতে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত যে জীবন হচ্ছে প্রোটোপ্লাজমের অস্তিত্বের বিশেষ রূপ।
চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২) ছিলেন ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী। ১৮৩১ সালে এইচ.এম.এল বিগল নামক জাহাজে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর এলাকার গালাপাগোস ও অন্যান্য দ্বীপের জীববৈচিত্র্য সংগ্রহ করে ১৮৩৬ সালে ফিরে আসেন। সংগৃহীত তথ্যভান্ডারের ভিত্তিতে তিনি রচনা করেন ‘দি অরিজিন অফ স্পেসিস বাই মিনস অফ ন্যাচারাল সিলেকশন’ (প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে জীবসমূহের উৎপত্তি)। ১৮৫৯ সালে এই ঐতিহাসিক বই প্রকাশিত হয়। জীবজগতের যে কোনো প্রজাতি তার সন্তান সন্ততির মাধ্যমে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। সে যেসব সন্তানের জন্ম দেয় তাদের মধ্যে বৈচিত্র্য দেখা যায়। গড়পড়তায়, কোনো প্রজাতি যত সংখ্যায় পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে, তার থেকে বহুগুণ বেশি সন্তানের জন্ম হতে দেখা যায়। এই সব সন্তানের মধ্যে টিকে থাকার জন্য একটা সংগ্রাম দেখা দেয়। তাকে ডারউইন বলেন অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম (স্ট্রাগল ফর এক্সিস্টেন্স)। কিছু কিছু সন্তানের মধ্যে সেই বৈচিত্র্য (variation) থাকে যা তাদের অস্তিত্বের সংগ্রামে সাহায্য করে। ফলে সেই বৈচিত্র্য বংশপরম্পরায় রক্ষিত হয় এবং কালক্রমে এক প্রজাতি থেকে ভিন্ন প্রজাতির জীবের উৎপত্তি হয়। এটাই ডারউইনের বিবর্তনের তত্ত্ব। ‘যোগ্যতমের টিকে থাকার অধিকার’ (survival of the fittest) এই তত্ত্বের একটি ভিত্তি।
মার্কস ও এঙ্গেলস ছিলেন ডারউইনের সমসাময়িক। তাঁরা ডারউইনের বিবর্তনবাদের তত্ত্বকে ব্যবহার করেছিলেন দ্বন্দমূলক বস্তুবাদী দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। ডারউইনের মতবাদ অনুযায়ী, মানুষের জন্ম হয়েছিল আধা মানব, কিছু বানর থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে। চার পায়ে দাঁড়ানো পশু যখন দু’পায়ে দাঁড়াতে শুরু করল এবং তার ফলে সামনের দুটো হাত মুক হয়ে গেল, তখনই ঘটল সেই আশ্চর্য বিবর্তন। জন্ম নিল মানুষ, যে শুধু আগেকার প্রাণীদের মত নিজেকে খাদ্য-সংগ্রহে সীমাবদ্ধ না রেখে তৈরি করল হাতিয়ার (tool)। প্রাক-মানব কোন প্রাণী যত উন্নতিই করুক না কেন, সর্বপেক্ষা স্থূল ধরনের পাথরের হাতিয়ারও কেউ তৈরি করতে পারেনি। এঙ্গেলস বানর থেকে মানুষের বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা দেখিয়েছেন।
বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে ডারউইনের আবিষ্কার ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু পাশাপাশি, ‘যোগ্যতমের টিকে থাকার’ (survival of the fittest) তত্ত্বের মাধ্যমে পুঁজিবাদী সমাজের শ্রেণী শোষণ ও বৈষম্যকে ন্যায় সঙ্গত করে দেখানোর একটা চেষ্টা শুরু হয়েছিল। “সামাজিক ডারউইনবাদ” (social Darwinism) নামে এক তত্ত্বের দেখা মেলে, যে তত্ত্ব সমাজে বিবর্তনে শ্রেনি সংগ্রামের ভূমিকাকে অস্বীকার করে। এঙ্গেলস ডারউইনের বিবর্তনবাদ সম্পর্কে বলেন, “এই প্রসঙ্গে সবার আগে ডারউইনের নাম করতে হয়। সমস্ত জৈব প্রজাতি (উদ্ভিদ, প্রাণী এবং মানুষ নিজেই) একটা লক্ষ লক্ষ বছর ব্যাপী দীর্ঘ বিবর্তনের ফল এটা প্রমাণ করে ডারউইনের আধিবিদ্যক ধ্যানধারণার উপর চূড়ান্ত আঘাত হানলেন”। তিনি ডারউইনের আবিষ্কারকে মানব ইতিহাস বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে মার্কসের ভূমিকার সঙ্গে তুলনা করেছেন। “জীবজগতের বিকাশের নিয়ম আবিষ্কার করতে গিয়ে ডারউইন যা করেছিলেন, তেমনি মার্ক্স মানব ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম আবিষ্কার করেছিলেন”।
কিন্তু যোগ্যতমের টিকে থাকা সংক্রান্ত ধারণা এঙ্গেলস গ্রহণ করেননি। ১৮৭৫ সালে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘ডারউইনের মতবাদের মধ্যে আমি বিবর্তনবাদকে স্বীকার করি। কিন্তু তার প্রমাণ হিসাবে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম ও প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রভৃতি যেসব ধারণা তিনি উপস্থিত করেছেন, সেগুলিকে আমি নব আবিষ্কৃত তথ্যের প্রাথমিক, অস্থায়ী ও অসম্পূর্ণ মুল্যায়ন বলে মনে করি। এখন যেসব লোকেরা সর্বত্র অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম দেখছেন (ভোক্ট, বুথনার প্রভৃতি) ডারউইনের আগে তাঁরা প্রকৃতি জগতে শুধু সহযোগিতাই দেখেছিলেন। উভয় ধারনাই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে সত্য কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো একটি অপরটির মতোই একপেশে। জড় ও জীব, প্রকৃতি – জগতের এই উভয় ক্ষেত্রে বস্তুসমূহের মধ্যে অন্তঃক্রিয়ায় সম্প্রীতি ও সংঘর্ষ, সহযোগিতা ও সংগ্রাম উভয়ই কাজ করে।”
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানব সমাজকে এমন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে যেখানে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামের অর্থ এটাই হতে পারে যে, উৎপাদকরা উৎপাদন ও বিনিময়ের ব্যবস্থাপনা নিজের হাতে নেবে কারণ এই ব্যবস্থাপনা যাদের হাতে আছে তারা আর সেটা চালাতে পারছে না। তার অর্থ আপনি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে পৌছবেন।”
অন্যান্য আরও অনেক ধর্মশাস্ত্রের মতো হিন্দু ধর্মশাস্ত্রও বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করে না। মনুসংহিতা শিক্ষা দেয় যে, স্রষ্টা ব্রহ্মা একটা উচ্চ-নীচ ভেদ অনুযায়ী ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের সৃষ্টি করেছেন এবং এই ভেদ অপরিবর্তনীয়। বর্ণ ব্যবস্থায় নিম্ন অবস্থানে থাকা শূদ্র ও অতিশূদ্রদের দমনের উপরই ভারতীয় সমাজের উদ্বৃত্ত আহরনের প্রক্রিয়া দাঁড়িয়ে আছে। একবিংশ শতকে এসে, যখন বর্ণবাদী ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে তখন হিন্দুত্ত্ববাদীরা বর্ণাক্রম ব্যবস্থার কড়াকড়ি পুনঃস্থাপিত করার জন্য ঘোষনা করেছে, ডারউইনের বিবর্তনবাদ শিক্ষার পাঠক্রম থেকে বাদ দিতে হবে। আজ নতুন করে ডারউইনবাদের চর্চা সেজন্য খুবই প্রাসঙ্গিক।