তেষ্টা পাওয়া মানে কী?

তেষ্টা পাওয়া মানে কী?

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

জল ছাড়া জীবন কল্পনাই করা যায় না। গভীর সমুদ্রের অণুজীব থেকে শুরু করে গাছপালা মানুষ সবাই এক অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা জলের সঙ্গে। কেউ কেউ অক্সিজেন ছাড়াই বাঁচতে পারে, কেউ আবার নিজের খাবার তৈরি করতে পারে, কিন্তু জল ছাড়া এক মুহূর্তও টিকে থাকা অসম্ভব। কারণ, প্রতিটি কোষের ভেতরে জীবনের প্রথম কাজই ছিল জল ধরে রাখা। আজও বেঁচে থাকার মূল শর্ত হল কোষের আর্দ্রতা বজায় রাখা।
আমাদের শরীরের প্রতিটি রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে জলের উপস্থিতিতে। জলের সঙ্গে লবণের সূক্ষ্ম ভারসাম্য নষ্ট হলেই কোষ ফুলে ওঠে বা শুকিয়ে যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, কোষ কখনোই “জল চাই ” বলে না। তৃষ্ণার অনুভূতি জাগে মস্তিষ্কে। জিভ আর গলা শুকিয়ে যাওয়া, আর হঠাৎ ক্লান্তি, সবই তো মস্তিষ্কের পাঠানো সংকেত, যা আমাদের জল খুঁজতে বাধ্য করে।
তৃষ্ণার নিয়ন্ত্রণে কাজ করে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস ও ব্রেইনস্টেম নামক অংশ। এখানে রয়েছে বিশেষ অঙ্গ, OVLT ও SFO। এরা সরাসরি রক্তে লবণের ঘনত্ব পরীক্ষা করে। যেন কোনো বিজ্ঞানী নদীর জল পরীক্ষা করছেন। রক্তে লবণ বেড়ে গেলে বা জল কমে গেলে এই অঙ্গগুলো স্নায়বিক সংকেত পাঠায় যা আমরা অনুভব করি তৃষ্ণা হিসেবে।
কিন্তু এখানে একটা চমক আছে। জল খাওয়ার পর রক্তে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। এতক্ষণ অপেক্ষা করা তো সম্ভব নয়। তাই মস্তিষ্ক অনুমান করে নেয় মুখ ও গলায় জল প্রবাহিত হওয়ার অনুভূতি কিংবা পেটের প্রসারণই দ্রুত সংকেত দেয় জল এসেছে, এবার তৃষ্ণা মিটবে।
জল ও লবণ—দুটিই জীবনের জন্য অপরিহার্য। স্নায়বিক সংকেত চালনা করা থেকে শুরু করে প্রোটিনের গঠন বজায় রাখা, প্রতিটি কোষের ভেতরের কাজ চালাতে সোডিয়াম আয়ন (Na+) প্রয়োজন। তবে লবণের অভাব হলে মস্তিষ্ক তৃষ্ণার মতো যন্ত্রণা দেয় না। বরং স্বাদ আর অনুভূতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে। ক্ষুধার সময় নোনতা খাবার স্বর্গীয় লাগে, কিন্তু প্রয়োজন না থাকলে তা স্বাদহীন হয়ে পড়ে। এভাবেই মস্তিষ্ক আমাদের লবণ খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে অনুভূতির মাধ্যমে।

তৃষ্ণার কাহিনী সব প্রাণীর জন্য এক নয়। মানুষ সরাসরি জল পান করে, বিড়াল-খরগোশ খাবার থেকেই জল সংগ্রহ করে। উট চর্বি ভেঙে জল তৈরি করে বা পেটে (পাকস্থলীতে) জমা রাখে ভবিষ্যতের জন্য। সামুদ্রিক ভোঁদড়রা আবার সমুদ্রের নোনতা জলও পান করতে পারে এবং শরীর থেকে আরও লবণাক্ত প্রস্রাব বের করে দেয়।
ইয়েলের গবেষক এলেনা গ্রাশেভা দেখিয়েছেন, উত্তর আমেরিকার মেঠো কাঠবিড়ালী আট মাসের শীতঘুমে এক ফোঁটা জল না খেয়েও বেঁচে থাকে। তাদের শরীর জল চাইছে, কিন্তু মস্তিষ্ক সংকেত উপেক্ষা করছে। এ যেন প্রকৃতির তৈরি এক বিস্ময়কর বর্তনী।

তৃষ্ণা কেবল শারীরিক প্রয়োজন নয়, এটি মস্তিষ্কের এক অনুমানভিত্তিক খেলা। সেখানে রক্তের রসায়ন, ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি, আর পরিবেশের চাপে তৈরি হয় জীবনের অন্যতম প্রবল চাহিদা। তাই বলা যায়, জল শুধু জীবন ধরে রাখে না, আমাদের অস্তিত্বের ধরনও গড়ে দেয়। সুতরাং, তৃষ্ণার্ত হওয়ার অর্থ কী? এই প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধরণে তৃষ্ণার্ত।

সূত্র: The neurobiology of thirst and salt-apetite by James CR Grove, et.al ; Neuron (Volume 112, Issue 24) (Dec18, 2024).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × two =