বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে ২০১৯ থেকে দিল্লীর বুকে সব রকম বাজির ক্রয় ও বিক্রয় বন্ধ হয়ে গেছে । এদিকে নয় নয় করেও ১৯৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের বুকে শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়দানের পর প্রায় ২৪ বছর অতিক্রান্ত। কালীপুজো বা দীপাবলীর শব্দদৈত্যকে বোতলবন্দি করার জন্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও পুলিশের সক্রিয়তা সত্যিই অভিনন্দন যোগ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, কয়েক বৎসর যাবৎ এই সক্রিয়তা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গেছে যদিও এই পশ্চিমবঙ্গের বুকেই শব্দবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন অন্তত ১২ জন মানুষ । এবছরেও বিজয়া দশমীর রাত্রে বাজি ফাটানোর প্রতিবাদ করায় নির্মম ভাবে প্রহৃত হয়েছেন বালুরঘাটের এক মহিলা আইনজীবি ও তাঁর অসুস্থ বৃদ্ধ পিতা।
বেআইনি বাজির কারখানা বন্ধ করার জন্য ২০১৫ সালে পরিবেশ আকাদেমির রজু করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রীন ট্রাইবুনাল পশ্চিমবঙ্গে সমস্ত রকম বেআইনি বাজির কারখানা বন্ধ করার নির্দেশ দেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ২০০৯ থেকে এই বেআইনি বাজি কারখানাগুলিতে বিস্ফোরণের ফলে কমপক্ষে ৭০ জন মারা গেছেন এবং অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন আরও অসংখ্য মানুষ ।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, করোনা আক্রান্ত ভারতবর্ষের বুকে আজ কেবলমাত্র শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণই যথেষ্ট নয় কারণ আলোর বাজিও ব্যাপকভাবে বায়ুদূষণ সৃষ্টি করে এবং এই বায়ুদূষণ করোনা আক্রান্ত মানুষদের মৃত্যুকে প্রায় অনিবার্য করে তোলে। মনে রাখা প্রয়োজন, করোনা রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে অসংখ্য মানুষ সেবা-শহীদ হয়েছেন ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশকর্মী, প্রশাসনিক আধিকারিক, যাঁরা করোনা-যুদ্ধে প্রথম সারির সৈনিক, তাঁরা অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। গতবছরের মতোই এবারকার পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের সর্বত্রই কালীপুজো ও দীপাবলীর আলোর উৎসব পালিত হোক মোম এবং প্রদীপের আলোয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সমস্তরকমের শব্দবাজি বা আলোর বাজি ব্যবহারের উপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা অত্যন্ত জরুরি।
মানুষ সুস্থভাবে বাঁচলে তবেই উৎসব। কিন্তু সামাজিক উৎসব যদি জাতীয় জীবনে সংকট সৃষ্টি করে তাহলে তা নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রীয় কর্তব্য। এই ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় স্তরে বিশেষ কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি, যদিও অভিনন্দনযোগ্য সদর্থক ভূমিকা পালন করতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যম। শ্রদ্ধেয় চিকিৎসকবর্গ বারবার রাষ্ট্রের কাছে দরবার করে চলেছেন যাতে এই করোনা অতিমারির সময়ে সমস্তরকম বাজি ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। পরিবেশ সুরক্ষা আইন ১৯৮৬ এবং ডিজাস্টার ম্যনেজমেন্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী রাষ্ট্রের হাতে যথেষ্ট আইনি ক্ষমতা রয়েছে বাজিকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করার। কেন্দ্র এবং সমস্ত রাজ্যগুলির এই ব্যাপারে তৎপর হওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রের উচিত, মানুষের মঙ্গলার্থে আজকের এই দাবি মেনে নেওয়া। আমরা কি কেউ কখনো ভুলতে পারবো যে সেদিন এই শব্দবাজির তান্ডবেই দিল্লীর সেই লাঞ্ছিতার আর্ত চিৎকার কেউ শুনতে পায়নি ? দুষ্কৃতীদের হাতে লাঞ্ছিতা সেই মহিলা পরের দিনই আত্মহত্যা করেছিলেন। আমরা ভুলতে পারিনা আমাদের বাড়িরই কারোর বাবা, কারোর মা, কারোর স্বামী বা বোন করোনাযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আসুন কালীপুজো এবং দীপাবলীর রাতে মোমবাতির আলোয় শব্দশহীদ ও সেবাশহীদদের স্মরণে অন্তত এক মিনিট নীরবতা পালন করি এবং সর্বতোভাবে বাজির বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদের শপথ সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিই ।