ছোটোবেলায় আমরা খুব লেত্তি-বাঁধা লাট্টু ঘোরাতাম। মাথাভারী কাঠের গোল লাট্টু, নীচের দিকটা সরু, তলায় একটা লোহার আল লাগানো। গায়ে শক্ত করে সরু দড়ি পেঁচিয়ে হাতটা একটু কোণাচে করে কব্জির এক বিশেষ মোক্ষম মোচড় দিয়ে মাটিতে ছুড়ে দিলেই লাট্টুখানা লেত্তি বেয়ে গড়িয়ে নেমে মাটিতে পড়ে আলের ওপর দাঁড়িয়ে বনবন করে ঘুরবে। হঠাৎ ভাবলে মনে হয়, এ তো মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম লঙ্ঘন করছে। কারণ ওইটুকু সরু একটা আলের ওপর খাড়া লাট্টুটার তো সোজা হয়ে থাকার কথা নয়, তার তো উলটে পড়ে যাবার কথা। তার বদলে ওটা খাড়া অবস্থায় ঘোরে কী করে? এর মূলে আছে কৌণিক ভরবেগ-এর (অ্যাঙ্গুলার মোমেন্টাম) খেল। ব্যাপারটা কী?
টিভিতে আমরা বরফ স্কেটিং-এর ঘূর্ণিনাচ দেখেছি। যিনি স্কেট করছেন তিনি প্রথম প্রথম হাত দুটো ছড়িয়ে দিয়ে আস্তে করে ঘোরেন। ক্রমে হাত দুটোকে শরীরের কাছে গুটিয়ে নেন, তখন ঘুরপাকের গতি বা বনবনানি বাড়ে। এটাই হল কৌণিক ভরবেগের কেরামতি। ওই দিয়েই ঘূর্ণি-গতি মাপা হয়। জাড্য-ভ্রামক (মোমেন্ট অব ইনার্শিয়া) বলে একটা ব্যাপার আছে যা কেবলি চাইবে ঘূর্ণি-গতি বা বনবনানি থেমে যাক। যিনি স্কেটিং করছেন তিনি যখন পালটা হিসেবে কৌণিক গতিবেগ বাড়িয়ে ওই জাড্য-ভ্রামক কমিয়ে দেন, তখনই তাঁর ভারসাম্য বজায় থাকে।
ঠিক একই নীতি কাজ করে ঘুরন্ত লাট্টুর ক্ষেত্রে। লাট্টুটাতে একটা জোর কোণাচে মোচড় দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল। এবার সেটা কৌণিক গতিবেগ অর্জন করল। সেই কৌণিক গতিবেগই লাট্টুটাকে ঘোরাতে লাগল, কেননা তখন তার ঘূর্ণন-অক্ষটা স্থিতিশীল হয়ে গেছে। এই ব্যাপারটাকে বলে জাইরোস্কোপিক প্রেসেশন। এরই জন্য ঘুরন্ত লাট্টু উলটে পড়ে না।
লাট্টুটা যখন বনবন করে ঘোরে তখন মাধ্যাকর্ষণ তাকে কেবলি নীচের দিকে টানে, তাকে উলটে ফেলে দিতে চায়। যতক্ষণ লাট্টুর কৌণিক ভরবেগ জোরালো থাকে ততক্ষণ সে মাধ্যাকর্ষণের শক্তিকে পরাজিত করে খাড়া অবস্থায় ঘুরতে পারে। কিন্তু একটু পরেই তার এই কৌণিক ভরবেগ কমতে থাকে, তার বনবনানিও ক্রমে কমতে থাকে, সে টলমল করে। শেষ পর্যন্ত মাধ্যাকর্ষণই জিতে যায়। তখন লাট্টুর ঘোরবার গতিবেগ একেবারেই কমে গেছে, লাট্টুটা আর মাধ্যাকর্ষণের টান উপেক্ষা করতে পারে না, ফলে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। কাজেই কিছুক্ষণের জন্য মাধ্যাকর্ষণের বলকে পরাজিত করলে কী হবে, শেষ পর্যন্ত ওই অমোঘ বলের কাছে হার না-মেনে তার উপায় নেই।
মজার ব্যাপার হল, আমাদের এই পৃথিবীটাও কিন্তু ঠিক ওই লাট্টুর নীতি মেনেই ঘুরে চলেছে। জাইরোস্কোপিক প্রেসেশন-এর দৌলতে তার ঘূর্ণন-অক্ষ মোটের ওপর স্থিতিশীলই থাকে। এই স্থিতিশীলতা থাকে বলেই আমাদের এই গ্রহের জলবায়ু আর ঋতুচক্র বজায় থাকে।