
কোনো অঞ্চলের শুষ্কতা বা আর্দ্রতা পরিমাপের জন্য জলবিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে বৈজ্ঞানিক সূচক হিসেবে আরিডিটি ইনডেক্স ( খরা সূচক ) ব্যবহার করে আসছেন ।এটি মূলত নির্ভর করে একটি এলাকার বৃষ্টিপাত (P) এবং সম্ভাব্য বাষ্পীভবন (PET)-এর অনুপাতের ওপর । এই সূচকের মান ১-এর কম হলে অঞ্চলটি শুষ্ক বলে ধরা হয়; আর বেশি হলে আর্দ্র।
এই সূচক ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা খরা পরিস্থিতির তীব্রতা অনুমান করতে পারেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জলের প্রাপ্যতার পরিবর্তন বোঝেন এবং কৃষি বা জলসম্পদ ব্যবস্থাপনায় জল বণ্টনের পরিকল্পনা করতে পারেন। খরার পূর্বাভাস, জল সম্পদের পরিকল্পনা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন, কিছু নিম্নভূমি অঞ্চল ( যেমন বতসোয়ানার ওকাভাঙ্গো বদ্বীপ) বাস্তবে এতটাই বেশি জল ধরে রাখতে পারে, যা কেবলমাত্র স্থানীয় বৃষ্টিপাত দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। অথচ, প্রচলিত খরা সূচক অনুযায়ী সেখানে কম জল থাকার কথা। এর মূল কারণ, এসব এলাকা শুধু স্থানীয় বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করে না, এরা দূরবর্তী পাহাড়ি অঞ্চল থেকে নদী ও ভূগর্ভস্থ জল প্রবাহের মাধ্যমে অতিরিক্ত জল পায়। এই অতিরিক্ত “জল ভর্তুকি”এই অঞ্চলের অনেক বেশি উদ্ভিদ ও প্রাণী জীবনের ধারক ।
ইতিহাসে দেখা যায়, এই ধরনের জলপ্রবাহ-নির্ভর অঞ্চলেই বড়ো বড়ো সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। মরুভূমিতে গড়ে ওঠা মরূদ্যান, নদীর তীরে সজীব জীববৈচিত্র্য, কিংবা একই জলবায়ুর অধীনে ভিন্ন ভিন্ন ভূতাত্ত্বিক অবস্থানে তৃণভূমি বনাম অরণ্যের সহাবস্থান – সবই পার্শ্বীয় প্রবাহের প্রভাব। অথচ ,প্রচলিত খরা সূচকে এই পাশ্ববর্তী জল প্রবাহকে ধরাই হয়নি। ফলে প্রকৃত জল প্রাপ্যতার চিত্র সম্পূর্ণভাবে প্রতিফলিত হয় না।
এই সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানী গঞ্জালো মিগুয়েজ-মাচো এবং ইয়িং ফ্যান একটি নতুন সংজ্ঞার্থর প্রস্তাব করেছেন। তারা এটিকে গ্লোবাল হিউমিডিটি ইনডেক্স (GHI_topo) নামে উল্লেখ করেছেন। এর সূত্র হলো— GHI_topo = (P + Q_lat)/PET
এখানে,
P = বৃষ্টিপাত
PET = সম্ভাব্য বাষ্পীভবন
Q_lat = নদী ও ভূগর্ভস্থ জল থেকে আগত পার্শ্বীয় প্রবাহ।
যদি কোনো অঞ্চলে পার্শ্বীয় প্রবাহ না থাকে, তবে Q_lat শূন্য হবে, আর সেই ক্ষেত্রে আগের খরা সূচকের সমান ফল পাওয়া যাবে।
গবেষকরা এই নতুন সূচকটি পরীক্ষা করেছেন ২০০৩–২০১৮ সাল অর্থাৎ, ১৫ বছরের জলবায়ু বিশ্লেষণ তথ্য ও উপগ্রহ ভিত্তিক উদ্ভিদতত্ত্বের তথ্য ব্যবহার করে। তাঁরা দেখেছেন, এই নতুন সূচকটি বাস্তব পরিবেশকে অনেক বেশি সঠিকভাবে প্রতিফলিত করে। পাহাড়ি এলাকায়, যেখানে বৃষ্টিপাতই একমাত্র জলের উৎস, সেখানে পুরনো ও নতুন উভয় সূচকের মান একই হয়েছে। কিন্তু নিম্নভূমিতে, যেখানে নদী ও ভূগর্ভস্থ জল প্রবাহ পৌঁছায়, সেখানে নতুন সূচক উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি আর্দ্রতার মান দেখিয়েছে।
ফলাফলে দেখা যায়, নতুন সূচকে বিশ্বে যেসব অঞ্চলে জল সরবরাহ-চাহিদার ভারসাম্য (GHI ≥ 1) বজায় রয়েছে, তার পরিমাণ পুরনো সূচকের তুলনায় ৩৩% বেশি। ভূমধ্যসাগরীয় শুষ্ক অঞ্চলে এর বৃদ্ধি প্রায় ২০৫%। পৃথিবীর মোট ভূমির প্রায় ১৬% অঞ্চলে পার্শ্ববর্তী জল প্রবাহ থেকে বছরে অন্তত ২৫০ মিমি জল যুক্ত হচ্ছে, আর প্রায় ১১% অঞ্চলে এর পরিমাণ ৫০০ মিমিরও বেশি।
এই মডেল এখনো সেচ ব্যবস্থা, বাঁধ, জলপ্রবাহ পরিবর্তনের মতো মানবসৃষ্ট প্রভাবকে অন্তর্ভুক্ত করে না ভূমির সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য ধরতেও এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবুও এটি জলের প্রাপ্যতার একটি অধিক বাস্তবসম্মত ও পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরছে। গবেষকরা ভবিষ্যতে এই নতুন সূচক ব্যবহার করে বিশ্বের উদ্ভিদবিন্যাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণের পরিকল্পনা করছেন।
সূত্র: A global humidity index with lateral hydrologic flows by Gonzalo Miguez-Macho, et.al ; Nature (06.8.2025).